দুনিয়া দৌঁড়াচ্ছে উন্নতির দিকে বাংলাদেশ ছুটছে ঠিক তার বিপরীত দিক
ধন্য আমরা ধন্য, জন্মভূমি-মাতৃভূমি স্বাধীন এই বাংলাদেশের ভেজাল পণ্যের জন্য। ধন্য না হয়ে পারলাম না চমৎকার ভেজালের সমারোহে। আমরা স্বাধীন, আমাদের দেশ স্বাধীন। ভালও স্বাধীন, মন্দও স্বাধীন। তাই স্বাধীনতার ভীড়ে সবাই সর্বভাবেই স্বাধীন। স্বাধীনতার স্বাধীকারে মানুষ কত ভাবে লাভ করে আসল ফেলে নকলের মাঝে। নকল সে তো এখন আকাশে-বাতাসে-মর্তে-পাতালে সর্বক্ষেত্রে। নকলের প্রভাবে মানুষ এখন ‘আসল’ কথাটাই ভুলে গেছে। আসল বলতে এখন আর কিছু নেই, সবই ভেজালে পরিপূর্ণ। আমাদের দেশের পণ্য বাজারের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়। ধানে চিটার, চালে-ডালে কাঁকর, চিনি-লবণে বালি, মিনারেল ওয়াটার বিলে-ঝিলের পানি, তেলে-ঘি এ মারাত্মক রাসায়নিক ভেজাল, সিমেন্টে ভেজাল, ঔষধে ভেজাল, মশলায় ভেজাল, খাবারে ভেজাল।
এখন তো রোজকার ব্যাপার ভেজাল ব্যবহার। নকল আর ভেজাল দুই-ই ভয়াবহরূপ প্রভাব বিস্তার করছে যক্ষারূপী গডফাদারদের মতো। ভালো পণ্য পেলে মজে যায়, পথ্যের অভাবে চাঙ্গা হয়ে বুকটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। যদি বলি যক্ষারূপী গডফাদাররা আমাদের দেশের বুকটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ঝাঁঝড়া করে ফেলেছে, তাহলে কি বড় বেশী অন্যায় হবে? একটি দেশের সমস্ত তৈরী পণ্য যদি ভেজাল পরিপূর্ণ থাকে তাহলে সেই দেশ কিভাবে উন্নতির আশা করে? দেশের পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তো দূরের কথা, দেশেই অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে গুদাম ঘরে।
আমদের সবকিছুর চাহিদা এখন বৈদেশিক পণ্যের প্রতি
দেশের মানুষ বিদেশী পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পরেছে, সেটা কি মানুষের দোষ? নাকি পণ্যের? আমদের সবকিছুর চাহিদা এখন বৈদেশিক পণ্যের প্রতি। এর মূল কারণ হচ্ছে দেশের ভেজাল আর নকল পণ্য। আমাদের দেশের পণ্যের মান এত নীচু যে দেশের খুব সাধারণ একজন মানুষও দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে চায় না, তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক- ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, খুব সাধারণ একটি কসমেটিক। দেশের ৭০% মানুষ ব্যবহার করে ভারতীয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। এটা আমাদের দেশেও তৈরী হচ্ছে অথচ দেশীয় পণ্য ব্যবহার করছে মাত্র ৩০% মানুষ। দরিদ্র দেশ বলেই এই ৩০% একেবারে নিম্নশ্রেণীর কিংবা নিম্নমধ্যবর্তী শ্রেণীর মানুষ ব্যবহার করছে। এ তো গেল ছোট একটি উদাহরণ। এমনি করে বিরাজ করছে দেশের সর্বক্ষেত্রে সবপণ্যে। আমি আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি, “বাটা” একটি পুরনো অতি পরিচিত খ্যাতিপূর্ণ জনপ্রিয় জুতা কোম্পানীর নাম। একসময় টেকসই জুতা কম্পানী হিসাবে এই কম্পানীর খুব সুনাম ছিল। বাটা কোম্পানী এখন এমন পর্যায় এসেছে কিছু দিন পর পর ১০%, ২০%, ৩০%, ৪০% ও ইত্যাদি ইত্যাদি ছাড় দিয়ে থাকে। এত ছাড়ের পরেও দোকানগুলোতে ভীড় দেখা যায় না। এর কারণ কি? বাটা কোম্পানীর মালিক নিশ্চয় জোর গলায় বলবেন না পণ্যের মান উন্নত হওয়ায় ৪০% ছাড় দিয়ে দেশের সেবা করছেন। শুধু বাটা নয়, শুধু জুতা কোম্পানীগুলোও নয় কিংবা কসমেটিক উৎপাদিত কোম্পানীগুলোই নয়, দেশের সমস্ত পণ্য উৎপাদিত কোম্পাণীগুলোর একই অবস্থা। একই ইনজেকশন- দেশী এবং বিদেশী।
আমরা কিন্তু পারতঃপক্ষে দেশীটা ব্যবহার করি না। শুধু ইনজেকশনই নয়, সকল ঔষধের ক্ষেত্রে একই অবস্থা, একই অবস্থা খাবারে, পোশাকে, সর্বক্ষেত্রে। অবশ্য জীবন রক্ষাকারী ঔষধ-খাবারের গুণগত মান যে দেশ রক্ষা করতে পারে না, সে দেশে অন্যান্য পণ্যের মান নিয়ে মাথা ঘামাবে এমনটা আশা করাও ঠিক না। সত্যি বলতে মাথা ঘামাবেটা কে?
দেশের সর্বক্ষেত্রের অবক্ষয় এসেছে আস্তে ধীরে
আমার মনে হয় বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবী সকল দেশ দৌঁড়াচ্ছে উন্নতির দিকে আর বাংলাদেশ ছুটছে ঠিক তার বিপরীত দিকে। দিনে দিনে আমাদের দেশের পণ্যের মান, পণ্যের গুণ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং কোথায় গিয়ে থামবে, আসা-যাওয়া কোন সরকারই কি ভেবেছেন? হয়তো ভেবেছেন, প্রকাশ করার সময় তারা পাননি। কখনও কখনও বেশ তোরজোড়ে সকল প্রকার পণ্য সামগ্রীক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার করা হয়ে থাকে। কোম্পানীগুলোকে খুব জোড়ে ঘুঁটাও দিয়ে থাকে সরকার, কিছু দিন পর আবার চাপা পরে থাকে। বর্তমান সরকারকে দোষ দিব কেন! স্বাধীনতার পর থেকে যদি কোন সরকার উৎপাদিত পণ্যের দিকে নজর দিত তাহলে দেশের উৎপাদিত পণ্যের মান এত নীচে নেমে আসে আসতো না। কোন কিছুই একবারে পরিবর্তন হবে না বা হয় না, প্রতিক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসে আস্তে ধীরে। আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রের অবক্ষয় এসেছে আস্তে ধীরেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ পর্যন্ত কোন সরকারই দেশের উন্নতির জন্য মূল উন্ননের দিকে ভূমিকা রাখেনি। হয়তো বা তাঁরা দেশটাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছেন, করছেনও। দেশ আর উন্নত হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না এতোটা তলিয়ে দেখছেন কিনা জানি না। হয়তোবা দেশের অসীম সমস্যার মধ্যে, বড় বড় সমস্যাগুলোর ভীড়ে এই ছোট্ট(!) ছোট্ট এই মৌলিক সমস্যাটাই ভাবনা থেকে বাদ পড়ে গেছে। আজও রয়ে গেছে ভাবনার অন্তরালে রয়ে গেছে জাতীয় সমস্যার অন্তরালে।
কম পরিশ্রমে রাতারাতি বৃত্তবান হওয়া যায়
দেশের উন্নয়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের নাগরিক এবং সরকার উভকে একই উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়। জনগণ চাইলে সরকার তা কিছুতেই রুখতে পারবে না, তেমনি সরকার চাইলে জনগণ বাঁধার কারণ হতে পারবে না। এই দুই পক্ষের মধ্যে সরকারকে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালণ করতে হবে, কারণ কোম্পানীর মালিক কেবলমাত্র তার লাভ বা মুনাফার চিন্তা করে থাকে। কিভাবে স্বল্পসময়ে অধিকতর অর্থ উপার্জন করা যায়, কম পরিশ্রমে রাতারাতি বৃত্তবান হওয়া যায়। ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে সেদিকে। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজালের মাধ্যমে মানুষের চরম সর্বনাস সাধন করছে। এদের মস্তিষ্কের নরম কেদারায় বসে লোভ নামক গুণপোকা শুধু তাদের ঐ গানই শোনায়। তখন তারা তাদের পণ্যের মানের কথা ভুলে যায়, আর দেশ তো অনেক দূরে।
দেশবাসীকে বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য থেকে বাচাঁতে পারেনা
সরকারের বেলায় তো তা হওয়ার কথা নয়, সরকার তো দেশের লাভের, জাতির মুনাফার চিন্তায় মগ্ন থাকে। এখানে কোন প্রতিযোগীতা নেই, কারণ দেশের জন্য যে করবে, দেশ তাকেই ভালবাশা দিবে, দিবে সম্মান, রাখবে স্মৃতিতে অমর করে। তবু কেন যে সরকার এই দিকটা দেখেও দেখে না শুনেও শুনে না। সরকারও কোম্পানীর মালিকদের মতো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। যে সরকারই আসে সেই সরকারই নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দে তন্ময় থাকে সারক্ষণ। দেশের উন্নতির-অবনতির কারণ খুঁজে বের করার অবসর কোথায়। একটা দেশের সরকার যদি দেশের পণ্যের মানের খবরাখবর রাখতে না পারে, আসল-ভেজাল বের করে কোম্পানীর প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারে, দেশবাসীকে বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য থেকে বাচাঁতে না পারে, তাদের কি সরকার হওয়া উচিত। জন্মভূমি-মাতৃভূমি-স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে প্রশ্নটা আমি অবশ্যই করতে পারি।
দেশে অন্তহীন সমস্যা মোকাবেলা করে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিজের স্বার্থ পায়ে দলে দেশের তরে আত্মনিয়োগ করতে পারে সেই তো দেশের সরকার। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ, আমাদের দেশ! এদেশ জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন নিস্বার্থ সরকার পেলনা, পেলনা কোন মহৎ আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক। তবে একেবারেই যে পায়নি সে কথাটা জোর গলায় বলতে পারছিনা। কেননা, সরকার প্রধানদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের ক্ষমতাসীন পূর্ণ মেয়াদকাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন না। আমি তাঁদেরকে এর মধ্যে টানবো না। তাঁরা কি করতেন, কি করতেন না তাও সমালোচনা করবো না। বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ, এই দেশটিতে রয়েছে হরেক রকমের অসংখ্য সমস্যা। আমার মনে হয় অসংখ্য সমস্যার প্রধান প্রাধান সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য। এই ভেজালের ভিতরেই রয়েছে ৮০% সমস্যা।
গুণগত মানসম্মত পণ্যেই একটি দেশের উন্নতির মূলে একটি। কারণ, একটি উন্নত জাতির প্রধান যে সমস্যাটা সমাধান হয়ে যায়, সেটা হলো অভাব, দারিদ্র্যতা। গরীব দেশ যদি অভাব আর দারিদ্র্যতা অনেকাংশে মুছে ফেলতে পারে তাহলে সেই জাতি উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে খুব বেশী বেগ পেতে হয় না। তাই বলে খুব সহজ ভাবাতাও ঠিক নয়। যেটা ভেবেই আমাদের দেশের আজ এই অবস্থা। আর সিঁড়ি বাইতে হলে চাই সুস্থ জনশক্তি। অসুস্থ খাদ্যদ্রব্য দিয়ে তো আর সুস্থ জনশক্তি গড়ার শ্বপ্ন দেখা যায় না আর দুর্বল জনশক্তি দিয়ে কোন সরকার তার দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না। করতে পারেন না দেশের উন্নতি।
জাতিকে ঠকিয়ে দেশটাকে পিছু হটাচ্ছে
এখন আসি কোম্পানীর মালিকদের বেলায়, আচ্ছা বলুন তো, এই ভেজাল পণ্যে আপনারা কতটা লাভবান? হয়তো উচু গলায় প্রতিবাদ করবেন পণ্যে কোন ভেজাল নেই। কোন একটি কোম্পানীর মালিকও স্বীকার করবেন না তাদের হীনমন্যতার কথা। বাধ্য হয়ে দেশবাশীই স্বীকার করে নিবে তাদের সৌভাগের কথা। কারণ প্রতিপণ্যে রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার কিংবা বিশেষ ছাড়। বলতেই হয় এটা তো কোম্পানীর মালিকদের সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর আর কোন দেশ এমন লোভের আকর্ষণীয় চমক দেখিয়ে ক্রেতাদের আহবান করে কিনা আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই শীর্ষমহলের জানা আছে, তাই কোন প্রকারের প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ হোক বা নাহোক শীর্ষমহল থেকে নিম্নমহল পর্যন্ত সবাই জানে, কেন এই বিশেষ ব্যবস্থা। আমি কোম্পানির মালিকদের একটি প্রশ্নই করবো, আপনারা এই বিশেষ আকর্ষণীয় ব্যবস্থা না করে, আপনাদের তৈরী জিনিসের প্রতি আকর্ষণীয় হতে পারেন না? দেশ-বিদেশে রঙে-ঢঙের বিজ্ঞাপন না করে উৎপাদেত পণ্যের মান উন্নত করতে পারেন না?
বিভিন্নভাবে অর্থ অপচয় করে জাতিকে ঠকিয়ে দেশটাকে পিছু হটাচ্ছেন, চমক লাগানো বিজ্ঞাপন করছেন, আকর্ষণীয় ছাড় দিচ্ছেন, সব-ইতো করছেন, শুধু করছেন না দ্রব্যটাকে মানসম্মত।
কোম্পানীর মালিকরা কি দেশের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে গেল? আমার কিন্তু তাই মনে হয়। কেননা, পণ্য মানসম্মত হলে বহিবিশ্বে আমাদের দেশের পণ্যের চাহিদা বহুলাংশে বেড়ে যাবে তখন দেশ উন্নত হবেই। দেশ উন্নত হলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার সুখ্যাতিটা আস্তে আস্তে মুছে যাবে। মুছে যাবে এদেশের অনেক নাগরিকের ক্ষুধার যন্ত্রণা, ফুটপাত ছেড়ে উঠে যাবে অন্ততঃ কোন একটি বস্তিতে, হ্রাস পাবে দেহব্যবসা ও ভিক্ষাবৃত্তি।
বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া কঠিন
আমাদের দেশের পণ্যের মান সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই অবহেলার স্বীকার এবং এই কারণে বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া কঠিন। এখানে ইত্তেফাক পত্রিকার পুরনো একটি সূত্র তুলে ধরছি। বাড্ডা থানাধীন খিলক্ষেত মার্কেটে ১২টি দোকানে সাভ্যিল্যান্স টিমের এক অভিযান পরিচালনা করে বিএসটিআই ও ক্যাপ প্রতিনিধিগণ। তখনকার সময় তাৎক্ষণিকভাবে সনদপ্রাপ্ত ডলফিন, সিটি, মোল্লা ব্যান্ডের লবনের নমুনা জনসমক্ষে পরীক্ষা করে আয়োডিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে মেরিডিয়াম ব্যান্ডের টমেটো কেচাপ, মডার্ন ব্যান্ডের অরেঞ্জ জেলী, আমের আচার সয়াসন, সপ্তডিঙ্গার কোয়ালিটি ব্যান্ডের আয়োডিন লবন, নিহারীকা ব্যান্ডের আমের আচার, সিকদার ব্যান্ডের বিস্কুট, অ্যারোটা ব্যান্ডের মিক্সড ফ্রুট জ্যাম, অপূর্ব প্রোডাক্টসের বিস্কুট, আইডিয়াল হোম ফুডের পাউরুটি, একমি ব্যান্ডের স্ট্রবেরী জ্যাম, প্রমিজ ব্যান্ডের টুতপেষ্ট, গাওয়া ব্যান্ডের বাটার অয়েল, কোহিনূর সোপ, এন্ড কসমেটিক টঙ্গী গাজীপুরের জেট বল কাপড় কাচার সাবানসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়। বিক্রেতাদের এসকল পণ্য বিক্রি না করার এবং ক্রেতা সাধারণদের উল্লেখিত পণ্য ক্রয় করা হতে বিরত থকতে অনুরোধ করা হয়েছে [সূত্রঃ ইত্তেফাক ৮ই জানুঃ ০৩ইং]। ক্রয় করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করাটাই কি সমস্যার সমাধান হল। ক্রেতারা কোনটা কিনলে আসলটা পাবে বলে দিলে ভাল হতো না? একটি মার্কেটে মাত্র ১২টি দোকানে অভিযান চালিয়ে ১৪টি কোম্পানীর পণ্য বিক্রি বা কেনা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। তাহলে বাংলাদেশের সব মার্কেটের সমস্ত পণ্য পর্যবেক্ষণ করলে কি দাঁড়াবে? যা দাঁড়িয়েছিল কনডেন্সস মিল্ক কোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল করে। হয়তো লাইসেন্স বাতিল হয়েছে, বাজার থেকে মিল্ক বাতিল হয়নি, বাতিল হয়নি কোম্পানী।
সরকারের দুর্বলতার কারণে জাতিকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করছে লাগামহীনভাবে
বর্তমানে বিভিন্ন চ্যানেল বিভিন্নভাবে দিনের আলোর মত পরিস্কার করে দেখিয়ে দেয় পণ্যের গুণ-মান। এসবের অর্থ কি? কোম্পানীর মালিকগণ এবং সরকার এর উত্তর দিবেন কি? তাদের উত্তর দেয়ার মতো কিছু নেই। কেননা, তারা তো জাতির নীরব ঘাতক। দেশের মানুষ নিম্নমানের ভেজাল খাদ্য খেয়ে, ব্যবহার করে আক্রান্ত হচ্ছে ঘাতক এবং দূরারোগ্য রোগে। এর জন্য দায়ী কে বা কারা? নির্দ্বিধায় কি বলতে পারিনা- সরকার এবং কোম্পানী মালিক। সরকারের মৌনতায়ই কোম্পানীগুলোর মেরুদণ্ড এত মজবুত। আর এদের প্রতারণার শিকার হচ্ছে দেশের অসহায় সাধারণ মানুষ। তারা নিরীহ সাধারণ মানুষ আর সরকারের দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করে জাতিটাকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করছে লাগামহীনভাবে।
দেশ এবং দেশের অসহায় দরিদ্র-অভাবী-দুঃস্থ জনগণকে ঠকিয়ে সরকারের নাকের ডগা দিয়ে ফাঁকি দিয়ে জাতিকে বঞ্চিত করছে। এরা শুধু মুনাফা চায়, চায়! চায়!, তাদের এ চাওয়ার কোন শেষ নেই, নেই সীমা। তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। অবশ্য নিয়ন্ত্রণ করার কোন পরিকল্পনা সরকারের আছে বলেও মনে হয় না। কেননা, সরকার ও প্রশাসনের উপর প্রভাব খাটিয়েই তাদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। আর সরকার দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষের আর্থিক দূরাবস্থা অবজ্ঞা করে গুটিকয়েক স্বেচ্ছাচারি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করছে। তা নাহলে তারা লাইসেন্স পায় কিভাবে? বাজারজাত করে কিভাবে?
পণ্যের মান যাচাই বাছাই করে বাজারজাত করার জন্য তো প্রশাসন রয়েছে। প্রশাসনের দায়িত্ব হলো পণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাজারজাতকরণের অনুমতি দেয়া। সেটা পেতেও বেগ পেতে হয় না। কারণ শুধুই কি পণ্যে ভেজাল, মানুষে নয়? কি প্রশাসনে? বাস্তবতা হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান নির্ণয় করে সার্টিফিকেট দেয়ার কাজে কখনোই তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়নি। প্রকৃত পক্ষে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম খুবই শিথিল। ফলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বলতে গেলে উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠান কতৃক কালেভদ্রে দু’একটি অভিযান পারিতোষিক দিয়ে নির্বিবাদে বেরিয়ে আসে পুনরায় ভেজাল দ্রব্য বাজারজাত করে চুটিয়ে মুনাফা অর্জন করে। অবশ্য তাদেরই বা কি করার আছে, যদি দেশের সরকারেরই কিছু করার না থাকে।
বর্তমান বিশ্ববাজারে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশ সরকারের সরকার প্রধানরা বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করে থাকেন। সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশে জন্য কল্যাণকর, কিন্তু এই কল্যাণটা কতদিন বজায় থাকে। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য মানেইতো পণ্য। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কিংবা পণ্যের বিনিময়ে অর্থ, আর আমাদের দেশের পণ্যের মানের অবস্থা কি তা সরকার প্রধানরা ভালভাবেই জানেন। আঙ্গুল ফোলে কলা গাছ হবার স্বপ্ন না দেখে উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত হলে অবশ্য আমরা সফল হতাম। বর্তমান বিশ্ববাজারে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তো দূরের কথা, অংশগ্রহণ করতে হলে বাংলাদেশের পণ্যেগুলোকে করতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও প্রতিযোগী। মনে করিয়ে দিচ্ছি চিংড়িমাছ রপ্তানির কথা, ভেজালের কারণে কোথায় নেমে আসতে হল।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশীয় পণ্যের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিদেশী চাহিদা হ্রাসের জন্যও পণ্যের মান উন্নত করা অতীব জরুরী। তাই বাংলাদেশ সরকারকে উৎপাদিত শিল্প কারখানাগুলোর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েই কঠোরতা প্রকাশ করতে হবে। জাতির উন্নয়নের স্বার্থে কখনো কখনো কঠোরতাকে একটু বেশী কঠোরে পরিণত করতে হবে। সহানুভূতিটাকে ঊহ্য রেখে, তবে সেটা মুহূর্তের কিংবা ক্ষণিকের জন্য নয়। জাতির সরকারের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলবো, সেই সন্তানই মানুষ হয়, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করে, যে বাবা-মা সোহাগ-শাসন, সঙ্গ-সময় দিয়ে সন্তান গড়ে। জাতির সন্তান মানুষ করুন, দেশবাসী হবে ঘরমুখী। ঘরমুখী হলে কি লোভ দেখানোর প্রয়োজন আছে? স্বর্গের সুখ-ই মানুষকে স্বর্গে টানে। অবশ্য স্বর্গ কারো কাছে নরক মনে হয় আবার নরক কারো কাছে স্বর্গে পরিণত হয়। আর এই জন্যই কিছু সংখ্যক স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আমাদের এই সবুজ শ্যামল স্বাধীন সার্বভৌমত্বটাকে করেছে নরকে পরিণত।
ধন্য আমরা ধন্য, জন্মভূমি-মাতৃভূমি স্বাধীন এই বাংলাদেশের ভেজাল পণ্যের জন্য। ধন্য না হয়ে পারলাম না চমৎকার ভেজালের সমারোহে। আমরা স্বাধীন, আমাদের দেশ স্বাধীন। ভালও স্বাধীন, মন্দও স্বাধীন। তাই স্বাধীনতার ভীড়ে সবাই সর্বভাবেই স্বাধীন। স্বাধীনতার স্বাধীকারে মানুষ কত ভাবে লাভ করে আসল ফেলে নকলের মাঝে। নকল সে তো এখন আকাশে-বাতাসে-মর্তে-পাতালে সর্বক্ষেত্রে। নকলের প্রভাবে মানুষ এখন ‘আসল’ কথাটাই ভুলে গেছে। আসল বলতে এখন আর কিছু নেই, সবই ভেজালে পরিপূর্ণ। আমাদের দেশের পণ্য বাজারের বাস্তবতা বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়। ধানে চিটার, চালে-ডালে কাঁকর, চিনি-লবণে বালি, মিনারেল ওয়াটার বিলে-ঝিলের পানি, তেলে-ঘি এ মারাত্মক রাসায়নিক ভেজাল, সিমেন্টে ভেজাল, ঔষধে ভেজাল, মশলায় ভেজাল, খাবারে ভেজাল।
এখন তো রোজকার ব্যাপার ভেজাল ব্যবহার। নকল আর ভেজাল দুই-ই ভয়াবহরূপ প্রভাব বিস্তার করছে যক্ষারূপী গডফাদারদের মতো। ভালো পণ্য পেলে মজে যায়, পথ্যের অভাবে চাঙ্গা হয়ে বুকটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। যদি বলি যক্ষারূপী গডফাদাররা আমাদের দেশের বুকটাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়ে ঝাঁঝড়া করে ফেলেছে, তাহলে কি বড় বেশী অন্যায় হবে? একটি দেশের সমস্ত তৈরী পণ্য যদি ভেজাল পরিপূর্ণ থাকে তাহলে সেই দেশ কিভাবে উন্নতির আশা করে? দেশের পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন তো দূরের কথা, দেশেই অবহেলিত হয়ে পড়ে থাকে গুদাম ঘরে।
আমদের সবকিছুর চাহিদা এখন বৈদেশিক পণ্যের প্রতি
দেশের মানুষ বিদেশী পণ্যের প্রতি ঝুঁকে পরেছে, সেটা কি মানুষের দোষ? নাকি পণ্যের? আমদের সবকিছুর চাহিদা এখন বৈদেশিক পণ্যের প্রতি। এর মূল কারণ হচ্ছে দেশের ভেজাল আর নকল পণ্য। আমাদের দেশের পণ্যের মান এত নীচু যে দেশের খুব সাধারণ একজন মানুষও দেশীয় পণ্য ব্যবহার করতে চায় না, তার একটি উদাহরণ দেয়া যাক- ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী, খুব সাধারণ একটি কসমেটিক। দেশের ৭০% মানুষ ব্যবহার করে ভারতীয় ফেয়ার অ্যান্ড লাভলী। এটা আমাদের দেশেও তৈরী হচ্ছে অথচ দেশীয় পণ্য ব্যবহার করছে মাত্র ৩০% মানুষ। দরিদ্র দেশ বলেই এই ৩০% একেবারে নিম্নশ্রেণীর কিংবা নিম্নমধ্যবর্তী শ্রেণীর মানুষ ব্যবহার করছে। এ তো গেল ছোট একটি উদাহরণ। এমনি করে বিরাজ করছে দেশের সর্বক্ষেত্রে সবপণ্যে। আমি আরেকটি উদাহরণ দিচ্ছি, “বাটা” একটি পুরনো অতি পরিচিত খ্যাতিপূর্ণ জনপ্রিয় জুতা কোম্পানীর নাম। একসময় টেকসই জুতা কম্পানী হিসাবে এই কম্পানীর খুব সুনাম ছিল। বাটা কোম্পানী এখন এমন পর্যায় এসেছে কিছু দিন পর পর ১০%, ২০%, ৩০%, ৪০% ও ইত্যাদি ইত্যাদি ছাড় দিয়ে থাকে। এত ছাড়ের পরেও দোকানগুলোতে ভীড় দেখা যায় না। এর কারণ কি? বাটা কোম্পানীর মালিক নিশ্চয় জোর গলায় বলবেন না পণ্যের মান উন্নত হওয়ায় ৪০% ছাড় দিয়ে দেশের সেবা করছেন। শুধু বাটা নয়, শুধু জুতা কোম্পানীগুলোও নয় কিংবা কসমেটিক উৎপাদিত কোম্পানীগুলোই নয়, দেশের সমস্ত পণ্য উৎপাদিত কোম্পাণীগুলোর একই অবস্থা। একই ইনজেকশন- দেশী এবং বিদেশী।
আমরা কিন্তু পারতঃপক্ষে দেশীটা ব্যবহার করি না। শুধু ইনজেকশনই নয়, সকল ঔষধের ক্ষেত্রে একই অবস্থা, একই অবস্থা খাবারে, পোশাকে, সর্বক্ষেত্রে। অবশ্য জীবন রক্ষাকারী ঔষধ-খাবারের গুণগত মান যে দেশ রক্ষা করতে পারে না, সে দেশে অন্যান্য পণ্যের মান নিয়ে মাথা ঘামাবে এমনটা আশা করাও ঠিক না। সত্যি বলতে মাথা ঘামাবেটা কে?
দেশের সর্বক্ষেত্রের অবক্ষয় এসেছে আস্তে ধীরে
আমার মনে হয় বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবী সকল দেশ দৌঁড়াচ্ছে উন্নতির দিকে আর বাংলাদেশ ছুটছে ঠিক তার বিপরীত দিকে। দিনে দিনে আমাদের দেশের পণ্যের মান, পণ্যের গুণ কোথায় এসে দাঁড়িয়েছে এবং কোথায় গিয়ে থামবে, আসা-যাওয়া কোন সরকারই কি ভেবেছেন? হয়তো ভেবেছেন, প্রকাশ করার সময় তারা পাননি। কখনও কখনও বেশ তোরজোড়ে সকল প্রকার পণ্য সামগ্রীক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। পত্রিকা এবং টেলিভিশনে প্রচার করা হয়ে থাকে। কোম্পানীগুলোকে খুব জোড়ে ঘুঁটাও দিয়ে থাকে সরকার, কিছু দিন পর আবার চাপা পরে থাকে। বর্তমান সরকারকে দোষ দিব কেন! স্বাধীনতার পর থেকে যদি কোন সরকার উৎপাদিত পণ্যের দিকে নজর দিত তাহলে দেশের উৎপাদিত পণ্যের মান এত নীচে নেমে আসে আসতো না। কোন কিছুই একবারে পরিবর্তন হবে না বা হয় না, প্রতিক্ষেত্রেই পরিবর্তন আসে আস্তে ধীরে। আমাদের দেশের সর্বক্ষেত্রের অবক্ষয় এসেছে আস্তে ধীরেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস আজ পর্যন্ত কোন সরকারই দেশের উন্নতির জন্য মূল উন্ননের দিকে ভূমিকা রাখেনি। হয়তো বা তাঁরা দেশটাকে উন্নতির উচ্চ শিখরে পৌঁছানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করেছেন, করছেনও। দেশ আর উন্নত হচ্ছে না, কেন হচ্ছে না এতোটা তলিয়ে দেখছেন কিনা জানি না। হয়তোবা দেশের অসীম সমস্যার মধ্যে, বড় বড় সমস্যাগুলোর ভীড়ে এই ছোট্ট(!) ছোট্ট এই মৌলিক সমস্যাটাই ভাবনা থেকে বাদ পড়ে গেছে। আজও রয়ে গেছে ভাবনার অন্তরালে রয়ে গেছে জাতীয় সমস্যার অন্তরালে।
কম পরিশ্রমে রাতারাতি বৃত্তবান হওয়া যায়
দেশের উন্নয়ন সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয়, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। দেশকে উন্নত করতে হলে দেশের নাগরিক এবং সরকার উভকে একই উদ্দেশ্যে কাজ করতে হয়। জনগণ চাইলে সরকার তা কিছুতেই রুখতে পারবে না, তেমনি সরকার চাইলে জনগণ বাঁধার কারণ হতে পারবে না। এই দুই পক্ষের মধ্যে সরকারকে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা পালণ করতে হবে, কারণ কোম্পানীর মালিক কেবলমাত্র তার লাভ বা মুনাফার চিন্তা করে থাকে। কিভাবে স্বল্পসময়ে অধিকতর অর্থ উপার্জন করা যায়, কম পরিশ্রমে রাতারাতি বৃত্তবান হওয়া যায়। ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে সেদিকে। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজালের মাধ্যমে মানুষের চরম সর্বনাস সাধন করছে। এদের মস্তিষ্কের নরম কেদারায় বসে লোভ নামক গুণপোকা শুধু তাদের ঐ গানই শোনায়। তখন তারা তাদের পণ্যের মানের কথা ভুলে যায়, আর দেশ তো অনেক দূরে।
দেশবাসীকে বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য থেকে বাচাঁতে পারেনা
সরকারের বেলায় তো তা হওয়ার কথা নয়, সরকার তো দেশের লাভের, জাতির মুনাফার চিন্তায় মগ্ন থাকে। এখানে কোন প্রতিযোগীতা নেই, কারণ দেশের জন্য যে করবে, দেশ তাকেই ভালবাশা দিবে, দিবে সম্মান, রাখবে স্মৃতিতে অমর করে। তবু কেন যে সরকার এই দিকটা দেখেও দেখে না শুনেও শুনে না। সরকারও কোম্পানীর মালিকদের মতো নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। যে সরকারই আসে সেই সরকারই নিজেদের সুখ-স্বাচ্ছন্দে তন্ময় থাকে সারক্ষণ। দেশের উন্নতির-অবনতির কারণ খুঁজে বের করার অবসর কোথায়। একটা দেশের সরকার যদি দেশের পণ্যের মানের খবরাখবর রাখতে না পারে, আসল-ভেজাল বের করে কোম্পানীর প্রতি কঠোর ব্যবস্থা নিতে না পারে, দেশবাসীকে বিষাক্ত খাদ্যদ্রব্য থেকে বাচাঁতে না পারে, তাদের কি সরকার হওয়া উচিত। জন্মভূমি-মাতৃভূমি-স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিক হিসেবে প্রশ্নটা আমি অবশ্যই করতে পারি।
দেশে অন্তহীন সমস্যা মোকাবেলা করে, দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য নিজের স্বার্থ পায়ে দলে দেশের তরে আত্মনিয়োগ করতে পারে সেই তো দেশের সরকার। দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশ, আমাদের দেশ! এদেশ জন্মের পর থেকে আজ পর্যন্ত কোন নিস্বার্থ সরকার পেলনা, পেলনা কোন মহৎ আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক। তবে একেবারেই যে পায়নি সে কথাটা জোর গলায় বলতে পারছিনা। কেননা, সরকার প্রধানদের মধ্যে কেউ কেউ তাঁদের ক্ষমতাসীন পূর্ণ মেয়াদকাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন না। আমি তাঁদেরকে এর মধ্যে টানবো না। তাঁরা কি করতেন, কি করতেন না তাও সমালোচনা করবো না। বাংলাদেশ একটি গরিব দেশ, এই দেশটিতে রয়েছে হরেক রকমের অসংখ্য সমস্যা। আমার মনে হয় অসংখ্য সমস্যার প্রধান প্রাধান সমস্যাগুলোর একটি হচ্ছে ভেজাল ও নকল পণ্য। এই ভেজালের ভিতরেই রয়েছে ৮০% সমস্যা।
গুণগত মানসম্মত পণ্যেই একটি দেশের উন্নতির মূলে একটি। কারণ, একটি উন্নত জাতির প্রধান যে সমস্যাটা সমাধান হয়ে যায়, সেটা হলো অভাব, দারিদ্র্যতা। গরীব দেশ যদি অভাব আর দারিদ্র্যতা অনেকাংশে মুছে ফেলতে পারে তাহলে সেই জাতি উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে খুব বেশী বেগ পেতে হয় না। তাই বলে খুব সহজ ভাবাতাও ঠিক নয়। যেটা ভেবেই আমাদের দেশের আজ এই অবস্থা। আর সিঁড়ি বাইতে হলে চাই সুস্থ জনশক্তি। অসুস্থ খাদ্যদ্রব্য দিয়ে তো আর সুস্থ জনশক্তি গড়ার শ্বপ্ন দেখা যায় না আর দুর্বল জনশক্তি দিয়ে কোন সরকার তার দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতে পারে না। করতে পারেন না দেশের উন্নতি।
জাতিকে ঠকিয়ে দেশটাকে পিছু হটাচ্ছে
এখন আসি কোম্পানীর মালিকদের বেলায়, আচ্ছা বলুন তো, এই ভেজাল পণ্যে আপনারা কতটা লাভবান? হয়তো উচু গলায় প্রতিবাদ করবেন পণ্যে কোন ভেজাল নেই। কোন একটি কোম্পানীর মালিকও স্বীকার করবেন না তাদের হীনমন্যতার কথা। বাধ্য হয়ে দেশবাশীই স্বীকার করে নিবে তাদের সৌভাগের কথা। কারণ প্রতিপণ্যে রয়েছে আকর্ষণীয় পুরস্কার কিংবা বিশেষ ছাড়। বলতেই হয় এটা তো কোম্পানীর মালিকদের সহানুভূতির বহিঃপ্রকাশ। আমাদের দেশের মতো পৃথিবীর আর কোন দেশ এমন লোভের আকর্ষণীয় চমক দেখিয়ে ক্রেতাদের আহবান করে কিনা আমার জানা নেই। নিশ্চয়ই শীর্ষমহলের জানা আছে, তাই কোন প্রকারের প্রতিবাদ নেই। প্রতিবাদ হোক বা নাহোক শীর্ষমহল থেকে নিম্নমহল পর্যন্ত সবাই জানে, কেন এই বিশেষ ব্যবস্থা। আমি কোম্পানির মালিকদের একটি প্রশ্নই করবো, আপনারা এই বিশেষ আকর্ষণীয় ব্যবস্থা না করে, আপনাদের তৈরী জিনিসের প্রতি আকর্ষণীয় হতে পারেন না? দেশ-বিদেশে রঙে-ঢঙের বিজ্ঞাপন না করে উৎপাদেত পণ্যের মান উন্নত করতে পারেন না?
বিভিন্নভাবে অর্থ অপচয় করে জাতিকে ঠকিয়ে দেশটাকে পিছু হটাচ্ছেন, চমক লাগানো বিজ্ঞাপন করছেন, আকর্ষণীয় ছাড় দিচ্ছেন, সব-ইতো করছেন, শুধু করছেন না দ্রব্যটাকে মানসম্মত।
কোম্পানীর মালিকরা কি দেশের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বি হয়ে গেল? আমার কিন্তু তাই মনে হয়। কেননা, পণ্য মানসম্মত হলে বহিবিশ্বে আমাদের দেশের পণ্যের চাহিদা বহুলাংশে বেড়ে যাবে তখন দেশ উন্নত হবেই। দেশ উন্নত হলে বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশের দারিদ্র্যতার সুখ্যাতিটা আস্তে আস্তে মুছে যাবে। মুছে যাবে এদেশের অনেক নাগরিকের ক্ষুধার যন্ত্রণা, ফুটপাত ছেড়ে উঠে যাবে অন্ততঃ কোন একটি বস্তিতে, হ্রাস পাবে দেহব্যবসা ও ভিক্ষাবৃত্তি।
বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া কঠিন
আমাদের দেশের পণ্যের মান সংরক্ষণের বিষয়টি খুবই অবহেলার স্বীকার এবং এই কারণে বাজারে মানসম্পন্ন পণ্য পাওয়া কঠিন। এখানে ইত্তেফাক পত্রিকার পুরনো একটি সূত্র তুলে ধরছি। বাড্ডা থানাধীন খিলক্ষেত মার্কেটে ১২টি দোকানে সাভ্যিল্যান্স টিমের এক অভিযান পরিচালনা করে বিএসটিআই ও ক্যাপ প্রতিনিধিগণ। তখনকার সময় তাৎক্ষণিকভাবে সনদপ্রাপ্ত ডলফিন, সিটি, মোল্লা ব্যান্ডের লবনের নমুনা জনসমক্ষে পরীক্ষা করে আয়োডিনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তবে মেরিডিয়াম ব্যান্ডের টমেটো কেচাপ, মডার্ন ব্যান্ডের অরেঞ্জ জেলী, আমের আচার সয়াসন, সপ্তডিঙ্গার কোয়ালিটি ব্যান্ডের আয়োডিন লবন, নিহারীকা ব্যান্ডের আমের আচার, সিকদার ব্যান্ডের বিস্কুট, অ্যারোটা ব্যান্ডের মিক্সড ফ্রুট জ্যাম, অপূর্ব প্রোডাক্টসের বিস্কুট, আইডিয়াল হোম ফুডের পাউরুটি, একমি ব্যান্ডের স্ট্রবেরী জ্যাম, প্রমিজ ব্যান্ডের টুতপেষ্ট, গাওয়া ব্যান্ডের বাটার অয়েল, কোহিনূর সোপ, এন্ড কসমেটিক টঙ্গী গাজীপুরের জেট বল কাপড় কাচার সাবানসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা হয়। বিক্রেতাদের এসকল পণ্য বিক্রি না করার এবং ক্রেতা সাধারণদের উল্লেখিত পণ্য ক্রয় করা হতে বিরত থকতে অনুরোধ করা হয়েছে [সূত্রঃ ইত্তেফাক ৮ই জানুঃ ০৩ইং]। ক্রয় করা থেকে বিরত থাকার অনুরোধ করাটাই কি সমস্যার সমাধান হল। ক্রেতারা কোনটা কিনলে আসলটা পাবে বলে দিলে ভাল হতো না? একটি মার্কেটে মাত্র ১২টি দোকানে অভিযান চালিয়ে ১৪টি কোম্পানীর পণ্য বিক্রি বা কেনা থেকে বিরত থাকার জন্য অনুরোধ করা হয়। তাহলে বাংলাদেশের সব মার্কেটের সমস্ত পণ্য পর্যবেক্ষণ করলে কি দাঁড়াবে? যা দাঁড়িয়েছিল কনডেন্সস মিল্ক কোম্পানীর লাইসেন্স বাতিল করে। হয়তো লাইসেন্স বাতিল হয়েছে, বাজার থেকে মিল্ক বাতিল হয়নি, বাতিল হয়নি কোম্পানী।
সরকারের দুর্বলতার কারণে জাতিকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করছে লাগামহীনভাবে
বর্তমানে বিভিন্ন চ্যানেল বিভিন্নভাবে দিনের আলোর মত পরিস্কার করে দেখিয়ে দেয় পণ্যের গুণ-মান। এসবের অর্থ কি? কোম্পানীর মালিকগণ এবং সরকার এর উত্তর দিবেন কি? তাদের উত্তর দেয়ার মতো কিছু নেই। কেননা, তারা তো জাতির নীরব ঘাতক। দেশের মানুষ নিম্নমানের ভেজাল খাদ্য খেয়ে, ব্যবহার করে আক্রান্ত হচ্ছে ঘাতক এবং দূরারোগ্য রোগে। এর জন্য দায়ী কে বা কারা? নির্দ্বিধায় কি বলতে পারিনা- সরকার এবং কোম্পানী মালিক। সরকারের মৌনতায়ই কোম্পানীগুলোর মেরুদণ্ড এত মজবুত। আর এদের প্রতারণার শিকার হচ্ছে দেশের অসহায় সাধারণ মানুষ। তারা নিরীহ সাধারণ মানুষ আর সরকারের দুর্বলতার সুযোগ পুরোপুরি গ্রহণ করে জাতিটাকে ঠকিয়ে মুনাফা অর্জন করছে লাগামহীনভাবে।
দেশ এবং দেশের অসহায় দরিদ্র-অভাবী-দুঃস্থ জনগণকে ঠকিয়ে সরকারের নাকের ডগা দিয়ে ফাঁকি দিয়ে জাতিকে বঞ্চিত করছে। এরা শুধু মুনাফা চায়, চায়! চায়!, তাদের এ চাওয়ার কোন শেষ নেই, নেই সীমা। তাদের এই স্বেচ্ছাচারিতা সরকারের পক্ষে নিয়ন্ত্রণ আদৌ সম্ভব কিনা জানি না। অবশ্য নিয়ন্ত্রণ করার কোন পরিকল্পনা সরকারের আছে বলেও মনে হয় না। কেননা, সরকার ও প্রশাসনের উপর প্রভাব খাটিয়েই তাদের স্বার্থসিদ্ধি করছে। আর সরকার দেশের অসহায় দরিদ্র মানুষের আর্থিক দূরাবস্থা অবজ্ঞা করে গুটিকয়েক স্বেচ্ছাচারি স্বার্থান্বেষী ব্যক্তিদের প্রভাবের কাছে নতি স্বীকার করছে। তা নাহলে তারা লাইসেন্স পায় কিভাবে? বাজারজাত করে কিভাবে?
পণ্যের মান যাচাই বাছাই করে বাজারজাত করার জন্য তো প্রশাসন রয়েছে। প্রশাসনের দায়িত্ব হলো পণ্যের মান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বাজারজাতকরণের অনুমতি দেয়া। সেটা পেতেও বেগ পেতে হয় না। কারণ শুধুই কি পণ্যে ভেজাল, মানুষে নয়? কি প্রশাসনে? বাস্তবতা হচ্ছে পণ্যের গুণগত মান নির্ণয় করে সার্টিফিকেট দেয়ার কাজে কখনোই তেমন একটা তৎপরতা দেখা যায়নি। প্রকৃত পক্ষে এ সংক্রান্ত কার্যক্রম খুবই শিথিল। ফলে উৎপাদিত পণ্যসামগ্রীর কোয়ালিটি কন্ট্রোল বা মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি বলতে গেলে উপেক্ষিতই রয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সরকারী প্রতিষ্ঠান কতৃক কালেভদ্রে দু’একটি অভিযান পারিতোষিক দিয়ে নির্বিবাদে বেরিয়ে আসে পুনরায় ভেজাল দ্রব্য বাজারজাত করে চুটিয়ে মুনাফা অর্জন করে। অবশ্য তাদেরই বা কি করার আছে, যদি দেশের সরকারেরই কিছু করার না থাকে।
বর্তমান বিশ্ববাজারে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা
বাংলাদেশ সরকারের সরকার প্রধানরা বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করে থাকেন। সেটা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশে জন্য কল্যাণকর, কিন্তু এই কল্যাণটা কতদিন বজায় থাকে। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য মানেইতো পণ্য। পণ্যের বিনিময়ে পণ্য কিংবা পণ্যের বিনিময়ে অর্থ, আর আমাদের দেশের পণ্যের মানের অবস্থা কি তা সরকার প্রধানরা ভালভাবেই জানেন। আঙ্গুল ফোলে কলা গাছ হবার স্বপ্ন না দেখে উৎপাদিত পণ্যের মান উন্নত হলে অবশ্য আমরা সফল হতাম। বর্তমান বিশ্ববাজারে চলছে তুমুল প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা তো দূরের কথা, অংশগ্রহণ করতে হলে বাংলাদেশের পণ্যেগুলোকে করতে হবে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও প্রতিযোগী। মনে করিয়ে দিচ্ছি চিংড়িমাছ রপ্তানির কথা, ভেজালের কারণে কোথায় নেমে আসতে হল।
একথা বলার অপেক্ষা রাখে না, দেশীয় পণ্যের অস্তিত্ব রক্ষা ও বিদেশী চাহিদা হ্রাসের জন্যও পণ্যের মান উন্নত করা অতীব জরুরী। তাই বাংলাদেশ সরকারকে উৎপাদিত শিল্প কারখানাগুলোর প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়েই কঠোরতা প্রকাশ করতে হবে। জাতির উন্নয়নের স্বার্থে কখনো কখনো কঠোরতাকে একটু বেশী কঠোরে পরিণত করতে হবে। সহানুভূতিটাকে ঊহ্য রেখে, তবে সেটা মুহূর্তের কিংবা ক্ষণিকের জন্য নয়। জাতির সরকারের উদ্দেশ্যে একটি কথাই বলবো, সেই সন্তানই মানুষ হয়, মা-বাবার মুখ উজ্জ্বল করে, যে বাবা-মা সোহাগ-শাসন, সঙ্গ-সময় দিয়ে সন্তান গড়ে। জাতির সন্তান মানুষ করুন, দেশবাসী হবে ঘরমুখী। ঘরমুখী হলে কি লোভ দেখানোর প্রয়োজন আছে? স্বর্গের সুখ-ই মানুষকে স্বর্গে টানে। অবশ্য স্বর্গ কারো কাছে নরক মনে হয় আবার নরক কারো কাছে স্বর্গে পরিণত হয়। আর এই জন্যই কিছু সংখ্যক স্বেচ্ছাচারিতার কারণে আমাদের এই সবুজ শ্যামল স্বাধীন সার্বভৌমত্বটাকে করেছে নরকে পরিণত।
No comments:
Post a Comment