হাত মিলান বিশ্ববাসী, সবাই মিলে পথশিশুদের জীবন আলোয় ভরে তুলি
ফুল ফুটে ঝরার জন্য, জোয়ার আসে ভাটার জন্য, ধুপ পুড়ে গন্ধ বিলানোর জন্য, বীজ জন্মে শস্য ফলানোর জন্য, শিশুর জন্ম হয় প্রজন্মের পর প্রজন্ম জন্ম দিয়ে পৃথিবীকে আলোকিত করার জন্য। শিশুরাই পরিবার সমাজ জাতি কিংবা পৃথিবীর ফলন্ত শস্য। শিশুরাই বীজ আবার শিশুরাই শস্য। কেননা, শস্য থেকেই বীজের উৎপত্তি আর মানুষ থেকে মানুষের সৃষ্টি; তাই পৃথিবীর শস্য মানুষ একথা বলার অপেক্ষা রাখেনা। পৃথিবীকে তারাই বাঁচিয়ে রেখেছে যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী। তাহলে এরা কারা? কি এদের পরিচয়? এই শিশুগুলো কি পৃথিবীর Homo sapiens গ্রোত্র নাকি Tayassuidac moluccensis গ্রোত্র?
যদি Homo sapiens এর গ্রোত্র হয় তাহলে এরা (শিশুগুলো) কেন এমন করে দিনে দিনে ঝড়ে যাচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে ধীরে ধীরে নিবিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর আলো। এরা জানেনা তারা কি করছে, জানেনা তাদের কি হচ্ছে, শুধু একজনকে দেখে আরেকজন এই খেলায় আনন্দে উচ্ছ্বাসে মেতে উঠছে। এমনি করে দিনে দিনে এই শিশুগুলো ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। এদের দেখার কেউ নেই, রোধ করার কেউ নেই, ভাবারও কেউ নেই, বলারও কেউ নেই, নেই শাসন করার কেউ, অভাব নেই শুধু যোগান দেয়ার।
এই শিশুদের জীবন আট দশটা সাধারণ শিশুর জীবনের মতো নয়। এই বয়সে শিশুরা থাকে বাবা মায়ের কোলে আর থাকে স্কুলে পড়াশুনায় ব্যস্ত। তাদেরও এখন থাকার কথা পরিবারিক বন্ধনে বাবা-মায়ের আদর স্নেহে, সময় কাটানোর কথা স্কুলে, মগ্ন থাকার কথা ছিল পড়াশুনায়। ভাগ্যের ফেরে এসব পাওয়া থেকে তারা বঞ্চিত, নিয়তি এদের ফেলে দেয় পথে পথে। তাই তারা পথশিশু, তারা টোকাই, এরা মাদকাসক্ত। এরা ক্ষুধার দায়ে জীবিকার জন্য বেছে নেয় রাস্তা, ঘুরে পথে পথে আর ঘুমায় বস্তা ঢুকে ফুটপাতে, ফ্লাইওভার কিংবা ফুটওভারের নিচে। পথশিশুদের ঘুমানোর কোনো জায়গা নেই, এরা দিনের পর দিন গোসল করে না, রাস্তায় যেখানে সেখানে মলত্যাগ করে, খারাপ লাগলে বা অসুস্থ হলে অনুভূতি প্রকাশ মতো জায়গা নেই। অবশ্য জায়গা প্রয়োজনও নেই কারণ এদের ভাল লাগার খারাপ লাগার অনুভূতি কাজ করে না।
যে সব শিশুরা পথে পথে বেড়ে ওঠে তাদেরই বলা হয়ে থাকে পথশিশু। পথশিশু, পথকলি, টোকাই বা ছিন্নমূল আমরা এদের কত নামেই না ডাকি। সারা দেশেই পথশিশু আছে তবে রাজধানীতে এদের সংখ্যা অনেক বেশি। প্রশ্ন একটাই এই শিশুগুলো কি দেশের নাগরিক? এরা কি মানুষ? রাষ্টের কোথায় এদের অবস্থান? আমি নিজে নিজেকে প্রশ্ন করেছি উত্তর দিতে পারিনি। কেননা আমিও, দেখেও না দেখার বান করছি। তাই প্রশ্নটা রাষ্ট্র পরিচালনাকারিদের কাছে, সুশীল সমাজের সুধীজনের কাছে, জনগণ নিয়ে যারা বড় বড় বক্তব্য দেন সেই বক্তাদের কাছে। আমি প্রশ্ন রাখতে চাই দেশের জনগণের কাছে, আমরা রোহিঙ্গা নিয়ে কত কিছুই না করেছি কিন্তু দেশের ভিতরে এই অবুঝ শিশুগুলোর কথা কখনোই ভাবছি না, দেখছিও না। এদের নিয়ে কেউ কিছুই করছে না, চাঁদা তুলছে না, সংগ্রহ করছে না খাদ্য, বস্ত্র, অর্থ কিংবা ঔষধ। এদের কষ্ট আমাদের দেশের মানুষকে নাড়া দেয় না, অনুভূতিতে আঘাত হানে না। মানবতার তাগিদে পরের দেশের জন্য আমরা অনেক কিছু করতে পারি নিজের দিকে তাকাতে পারিনা। আমরা যখন পেট ভরে খাই আরাম করে ঘুমাই তখন কি একবারও রাস্তায় পড়ে থাকা এই নেশাগ্রস্ত শিশুগুলোর কথা আমাদের মানবতায় নাড়া দেয় না, বিবেকে আঘাত করে না। বিবেকের তাড়নায় পরের দেশের জন্য এত কিছু করতে পারি আর নিজের দেশের কিছু নীড়হারা পথশিশুদের জন্য কিছুই করতে পারি না। শীতে কিংবা ঝড় -বৃষ্টিতে এদের দিন কিংবা রাত কিভাবে কাটে আমরা কখনো ভেবে দেখেছি কি, অনুভব করেছি কি তাদের অবস্থা। একবার নিজের সন্তানের কথা মনে করে এই শিশুগুলোর কথা ভেবে দেখুন না তাদের কতটা কষ্ট হচ্ছে। কতটা নির্মমভাবে দিন যাপন করছে। শুধু একবার ভেবে দেখুন নিজের দিকে তাকিয়ে, তাহলে বুঝতে পারবেন এই শিশুগুলো শারীরিকভাবে ও মানসিকভাবে দিনযাপনের নির্মমতার কথা। নিজেদের প্রতি আমরা কতটা নির্দয়, কতটা নির্মম। পরের দেশের জন্য অনেক মায়া নিজের দেশের দিকে ফিরেও তাকায় না। হায়রে মানবতা! একেই বলে মানবতা!
এই শিশু ছেলেমেয়েরা হয়তো হতে পারতো পৃথিবীর অনেক অজানাকে জানার কোন এক বা ততোদিক বিষয়ের উদ্ভাবক। এদের মধ্যেও তো লুকিয়ে থাকতে পারে কোন এক জিনিসের আবিষ্কারক, যার দ্বারা পৃথিবীর Homo sapiens গ্রোত্রে বিরাট সাফল্য বয়ে আনতে পারে। সেই সাফল্যের দ্বারা বাঁচাতে পারে বিশ্বের মানব জাতি আবার এদের দ্বারা কোন কিছু নাও হতে পারে। কিন্তু তবু তারা Homo sapiens। পথশিশু থেকে অনেকেই জগৎ বিখ্যাত হয়েছেন, পৃথিবীতে এ নজির তো আছে। পৃথিবীর সব শিশুরা বিশ্ববিখ্যাত হবে না, গণ্যমান্য হবে না এটা সত্যি কিন্তু তারা সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার রাখে। এই শিশুগুলো পৃথিবীর কাছ থেকে কি পাচ্ছে! এই অবুঝ শিশুরা আজ একে একে দিনের পর দিন পলিথিনে জুতার পেস্টিং বা আঠা যা গামবেল্ডিং নামে পরিচিত ‘ড্যান্ডি’ দিয়ে নেসায় অভ্যস্থ হয়ে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে।
এই শিশুগুলো নিম্নবিত্ত, বস্তীবিত্ত সমাজের সন্তান; তবু তারা মানুষ। এরা যেসব উপাদান দিয়ে তৈরি বিশ্বের উচ্চবিত্ত সমাজের শিশুরাও ঐ একই উপাদানে তৈরি। তাহলে পার্থক্য কোথায়? পার্থক্য অবাশ্যই আছে, তা শারীরিক গঠনে নয় কিংবা তৈরি উপাদানে নয়, পার্থক্য বিত্তে, সমাজে, অর্থে মানবতার শ্রেণিভেদে। এদের বলার কেউ নেই, শ্বাসন করার কেউ নেই, নেই আদর স্নেহ ভালবাসা দিয়ে ভাল মন্দ বোঝানোর। সারা দিন পথে পথে ময়লা-আবর্জনায় থেকে থেকে এই শিশুগুলো পেস্টিং বা ড্যান্ডি নেশা করে আনন্দে মেতে থাকে। এদের জন্য এটাই বিনোদন, এই বিনোদনের মাধ্যম আনন্দে মেতে উঠে। এদের আনন্দ করার অন্য কোন বিষয় নেই, এরা কখনো উচু সমাজের বিত্ত খাবারের তো দূরের কথা অতিসাধারণ খাবারেরও চাহিদা নেই, দামী দামী কাপড়ের চাহিদা নেই, চাহিদা আছে শুধু এক টুকরা পলিথিন আর জুতার পেস্টিং -এর গামবেল্ডিং কৌটার। পলিথিনে একটু গামবেল্ডিং পেলে কি-যে আনন্দ পায় কতটা খুশি হয় বাস্তবে ভালভাবে খেয়াল করে না দেখলে উপলব্দি করা যাবে না, ভাবা যাবে না এই শিশুগুলোর ভবিষ্যৎ। এরা কি মানুষ! সত্যিই মানুষ! তাহলে এদের নিয়ে কেন কেউ ভাবছে না, দেখছে না, বোধ করছে না। কেন একে একে বেড়েই যাচ্ছে নেশাগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যা। ঢাকা শহরের প্রায় প্রতি অলি গলিতে এই শিশুদের দেখা যায়। রাস্তায় পড়ে থাকা এই শিশুদের হাতে থাকে গামবেল্ডিং লাগানো একটা পলিথিন আর থাকে একটা বস্তা। তারা টোকাই, তারা রাস্তায় যা পায় ভাঙ্গাচুরা, প্লাস্টিক, লোহা ইত্যাদি ফেলে দেয়া নানা রকমের জিনিস কুড়িয়ে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে উপার্জন করে। কিন্তু পলিথিন হাত ছাড়া করে না। কিছুক্ষণ পর পর মুখে দিয়ে শ্বাস নেয়। কখনো কখনো একে অপরে পলিথিন নিয়ে কাড়াকাড়ি করে একজন আরেকজনের কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার জন্য। আমি দেখেছি কাড়াকাড়ি করতে গিয়েও অনেক অনন্দ করে আবার অনেক সময় কারো কাছে না থাকলে স্বেচ্ছায় সেধে দেয়। দেখলে মনে হয় একটা চকলেট খুব সুন্দর করে ভাগাভাগি করে খাচ্ছে।
একদিন মতিঝিলে এক শিশুকে জিজ্ঞেস করি তুমি কি খাচ্ছ শিশুটি বলে কই কিছু না, আমি বলি এই যে হাতে শিশুটি তাড়াতাড়ি তার হাতে একটা বস্তা ছিল বস্তার ভিতর ঢুকিয়ে দৌড়ে চলে যায়। আরেকদিন একটি মেয়ে বয়স ১৩-১৪ বছরের মত হবে, মেয়েটি ওড়নার নিচে পলিথিন লুকিয়ে রেখে কিছুক্ষণ পর পর মুখে শ্বাস নিচ্ছে আর দোকানে দোকানে ঘুরছে। দোকানের মালিক কিংবা কর্মচারীর সাথে বেলাল্লাপনা করছেন, অনেকেই তাড়িয়ে দিচ্ছে। এই কিশোরী মেয়েটি নেশাগ্রস্ত তাই বুঝতে পারছেনা ওর কি করছে। এটা ঢাকার মানিকনগরের বাসস্ট্যান্ডের র্ঘটনা। রাত প্রায় সাড়ে আটটা আমি বাসের জন্য দাঁড়িয়ে আছি হ্ঠাৎ মেয়েটিকে চোখে পড়ে যায় মেয়েটির অদ্ভুত আচরণের কারণে। আমি মেয়েকে ফলো করতে থাকি। আমি যে ওকে ফলো করছি বুঝতে পেরে সরে পড়ে। মেয়েটির পোষাক খুবএকটা খারাপ ছিলনা, মোটামুটি ভাল পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, মেয়েটি দেখতেও ভাল। আমি প্রথম বুঝতে পারিনি ও ওড়নার নিচে পলিথিন লুকিয়ে রেখেছে। যখন দেখলাম ওড়না দিয়ে মুখ ঢেকে শ্বাস নিতে তখন অবাক হয়ে গেলাম এই মেয়েটি কি করছে। এরকম ঝকঝকে তরুণী মেয়ে যে এ নেশা করতে পারে, না দেখলে বিশ্বাস হত না। বর্তমানে এরকম অনেক মেয়ে আছে আমাদের দেখার আড়ালে। এভাবে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে এই প্রজন্মের নিম্নবিত্ত শিশু কিশোর-কিশোরীরা। এসব কিশোরীরা শুধু নেশায় ধ্বংস হচ্ছে তা তো না, এরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়ত। নেশা কিংবা যৌন নির্যাতনের হাত থেকে এসব কিশোরীদের রক্ষা করার জন্য কেউ কোনো পরিকল্পনা বা উদ্যোগ নিচ্ছে না।
এখন সময় রোধ করার, এই শিশুগুলোকে বাঁচানোর এখনই সময়। এখন যদি রোধ করা না যায় তাহলে ভবিষ্যতে জাতির প্রকট আকার ধারণ করবে। প্রথমত এদের থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম আর খুব বেশি প্রবাহিত হবে না। দ্বিতীয়তঃ অল্প পয়সায় পাওয়া যায় বলে এ নেশার প্রবণতা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। পথশিশুদের দেখে স্কুলের শিশুরাও উৎসাহিত হতে পারে। যেমন ড্রাগ কিংবা ইয়াবা দ্বারা এখন উচ্চবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত ছেলে-মেয়েদের আসক্ত হওয়ার প্রবণতা দিন দিন বেড়েই চলছে। শুধু ছেলে মেয়েরা কেন পরিবারের প্রধানরাও আসক্ত হতে দেখা যাচ্ছে। তাই সব সমাজের শিশুদের নিরুৎসাহিত করতে এই নেশায় আসক্ত শিশুদের দ্রুত সুস্থ করার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে, নেশাগ্রস্ত শিশুদের সংখ্যা যেন বাড়তে না পারে সেই দিকে নজর দিতে হবে। নেশার উপকরণ হাতের নাগালের বাইরে নিতে হবে। নেশাগ্রস্ত শিশুদের রাস্তা থেকে তুলে যত দ্রুত সম্ভব নিরাময় কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে যাতে এদের দেখে অন্য শিশুরা উৎসাহী হতে না পারে। নিরাময় কেন্দ্রের সংখ্যা বাড়িয়ে এসব শিশুদের তুলে নিয়ে সুস্থ করতে হবে। এটা একটা দেশের মৌলিক দায়িত্ব কেননা সব শিশুরাই দেশের নাগরিক। যুবসমাজ ধ্বংস হলে দেশ ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে শিশুসমাজ ধ্বংস হলে তো আর দেশের যুবসমাজ সৃষ্টি হবে না। এখন ভাবার সময় এই নেসা কিভাবে রোধ করা যায়, কিভাবে এই শিশু কিশোরদের বাঁচানো যায়।
দেশের কর্ণধাররা বড় বড় গাড়ি দিয়ে চলে তাই তাদের চোখে নাও পড়তে পারে কিন্তু সমাজপতিদের চোখে তো পড়ে। তাদের উচিত এই সমস্যা নিয়ে ভাবা, সমাধানের পথ খোঁজা। সমাজের সবাই মিলে এর সমাধান করলে আজ সমস্যা এতো এত বড় আকার ধারণ করত না। সবাই শুধু নিজের মত নিজেকে নিয়ে থাকে দেশের জন্য সমাজের জন্য ভাবতে চায় না। বিশেষ করে নিম্ন শ্রেণীর মানুষের জন্য কেউ কিছুই করতে চায় না। তাদের প্রতি কিছু করার আগ্রহ খুবএকটা দেখায় যায় না, তেমন একটা চোখে পড়ে না। কিন্তু তারাও মানুষ তাদের অনুভূতি আছে আমার আপনার সবার মতো। তাদের অবহেলা করার কারণে একসময় হয়তো আক্কেল সেলামি দিতেও হতে পারে নিজের সন্তান দিয়ে। নিজের সন্তান যখন এই পরিস্থিতির শিকার হবে তখন সবারই টনক নড়বে তার আগে না।
দেশের বিত্তবান মানুষদের সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে এসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের দিকে। এদের অন্ধকার অনিশ্চিত জীবন থেকে বের করে আনার দ্বায়িত্ব সবার। নিজ নিজ উদ্যোগে যার যার অবস্থান থেকে বঞ্চিত শিশুদের প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্য পালন করতে হবে। আমাদের মনুষ্যত্ববোধই পারে এদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে এনে মানুষ করে গড়ে তুলতে। শুধু দরকার সবার সম্মিলিত উদ্যোগ, সবার সম্মিলিত উদ্যোগই পারে বঞ্চিত শিশুদের মানুষ করে জাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করতে। জাতিকে সভ্য জাতিতে পরিণত করা সুনাগরিকদের বিশেষ করে অর্থবানদের নৈতিক দায়িত্ব।
একটা পরিবারের উত্তরসূরি তার সন্তান, একটি দেশের ভবিষ্যৎ দেশের নাগরিক। পথ শিশুদের প্রতি কোন দেশে দায়িত্ব এড়াতে পারে না। কেননা যে কোন দেশের যে কোন শিশুই তার দেশের মৌলিক অধিকার ভোগ করার অধিকার রাখে। মৌলিক অধিকার গুলোর মধ্যে খাদ্য এবং শিক্ষা ব্যবস্থা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। খাদ্য ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারে না শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি যেমন উন্নতি করতে পারে না তেমনি পথশিশু অবহেলায় বঞ্চিত করে কোন জাতি সভ্য কিংবা সমৃদ্ধ হতে পারে না। প্রতিটা জাতির প্রতিটা সরকারের উচিত এ পথশিশুদের মৌলিক অধিকার গুলো দিয়ে এদের দেশের সম্পদ হিসেবে গড়ে তোলা। এদের শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রতিটা স্কুলের প্রতিটা ক্লাসে বিনা পয়সায় কোটা তৈরি করে দেওয়া। এতে করে এই পথ শিশুগুলো ঝরে পড়বে না বরং সভ্য সুন্দর পরিবেশে থেকে এরাও একে একে দেশের সম্পদ হয়ে উঠবে। স্কুলে বেতনের বাইরে যে বিরাট অঙ্কের অর্থের প্রয়োজন সেটা সংগ্রহ করতে হবে বিত্তবানদের কাছ থেকে। প্রত্যেক বিত্তবান ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানকে বাধ্য করতে হবে জাতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে এদের প্রতি কর্তব্য পালন করার। বিত্তবানদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে পথশিশুদের মানুষ করার জন্য একটা ফান্ড তৈরি করা যায়, যাকাতের সংগ্রহের মাধ্যমে একটি বড় আকারের ফান্ড গঠন করা যায়, যা দিয়ে খুব সহজেই পথশিশুদের মানুষ করে গড়ে তোলা সম্ভব।
সরকারের উচিত এই পথশিশুদের জন্য আবাসিক হোস্টেলের ব্যবস্থা করা। অনেক সরকারি খালি জায়গা কিংবা পরিত্যক্ত বিল্ডিং থাকতে পারে যেখানে ব্যবস্থা করা যায়। যদি খালি কিংবা পরিত্যক্ত বিল্ডিং না থাকে তাহলে বলব খালি জায়গা তো আছে সেখানে বিল্ডিং করা যেতে পারে। বিল্ডিং করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না। প্রবাসীরাও দেশের নাগরিক তাদেরও দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই দায়বদ্ধতা থেকেই তাদের উচিত এসব সুবিধাবঞ্চিত পথশিশুদের মানুষ গড়ার জন্য অর্থ যোগান দেয়া। বিল্ডিং করার অর্থ প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করতে হবে। খুব বিশাল আকারের কিছু করতে হবে না। কেননা, ওরা শিশু এদের অল্প জায়গায় অধিক সংখ্যক শিশু রাখা যাবে। শুধু প্রয়োজন সভ্য জাতি গড়ার জন্য কিছু পরিকল্পনা আর বাস্তবায়নের মানসিকতা।
এই পথশিশুদেরও নিয়ে রাজনীতির শেষ নেই। বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে এদের ব্যবহার করে থাকে শুধুমাত্র নিজেদের নাম প্রচারের জন্য। কখনো এই শিশুদের ঘটা করে খাবার বিলি করে, কখনো নতুন পোশাক বিলি করে, কখনো রাজভোগের আয়োজন করে, কখনো করে খেলাধুলার আয়োজন ইত্যাদি ইত্যাদি আয়োজনের যেন শেষ নেই। প্রচারও হয়ে থাকে বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমগুলোতে, কিন্তু এই আয়োজনে বা প্রচারে কি হবে যদি না এদের জীবনের কোন পরিবর্তন না আসে। এদের যদি পথেই থাকতে হয় তাহলে মাঝেমধ্যে বছরে দু’একদিন এই আয়োজনে এদের কি লাভ হবে। রাজকীয় খাবার খেয়ে যদি জুতার পেস্টিং বা গামবেল্ডিং দিয়ে নেশা করতেই হয় কিংবা নতুন কাপড় পরে ময়লার ডিপোতে ডুব দিতেই হয় তাহলে এই আয়োজনে কি সার্থকতা! অনেকেই পথশিশুদের জন্য অনেক কিছু করেন ক্ষণস্থায়ী কিছুক্ষণের জন্য। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার কোন ব্যবস্থার উদ্যোগ কেউ নিচ্ছে না যাতে এদের রাস্তা থেকে তুলে এনে এদের সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবন গড়া যায়। এসব লোক দেখানো আয়োজনের অর্থ দিয়েই কিন্তু এদের মানুষ করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। এদের জীবন গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে ঐ একই অর্থ, শুধু দরকার মনোভাবের পরিবর্তন। পরিকল্পনা নিয়ে সবার সব আয়োজনের অর্থ একসাথে করে এই শিশুদের সুন্দরভাবে মানুষ করে গড়ে তোলা যায়। বাস্তবতার জন্য অর্থ মূল বিষয় নয়, মূল বিষয় উদ্যোগ গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের।
একটা কথা না বললেই নয় এই শিশুগুলোর জন্মদাতারা অর্থাৎ এদের বাবা-মা তাদের প্রতি কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য থেকে যা সরকারের। তারা এভাবে একের পর এক সন্তান জন্ম দিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঠেলে দিয়ে জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে না। তাদের প্রতিও সরকারের কঠোর হতে হবে যাতে তারা পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নিয়ম মানতে বাধ্য হয়। পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব নিতে হবে। তাদের বাধ্য করতে হবে যাতে তারা দু’টোর বেশি সন্তান না নিতে পারে। প্রয়োজনে স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিতে হবে। ব্হু বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদ, দারিদ্র্যতা ইত্যাদি যেসব মৌলিক কারণে পথশিশু তৈরি হচ্ছে এবং ক্রমান্বয়ে বেড়ে যাচ্ছে সেসব কারণগুলো রোধ করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা এবং তা বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরী। পথশিশু তৈরি হওয়ার মূল কারণ নির্মূল করার বিষয়ে কোনো কার্যক্রম বাস্তবায়নের পরিকল্পনা বাস্তবে দেখা যাচ্ছে না। মূল কার্যক্রম বাস্তবায়ন না হলে পথশিশু রোধ করা যাবে না বরং ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকবে এদের সংখ্যা। সর্বপ্রথম দরকার দ্রুত কারণ নির্মূল করে প্রয়োজনী ব্যবস্থা নেয়া। এ জন্য প্রয়োজন দেশের সব শ্রেণীর মানুষকে এগিয়ে আসা এবং বাস্তবায়নে সহযোগিতা করা।
বর্তমান পথশিশুদের সুস্থ জীবনের ব্যবস্থা করার পরে যাতে নতুন কোনো পথশিশু তৈরি হতে না পারে সেই দিকে নজর রাখতে হবে। যখনই কোনো নতুন পথশিশু রাস্তায় দেখা যাবে সাথে সাথে কারণ খুঁজে বের করে এর ব্যবস্থা নিতে হবে। যদি বাবা-মা থাকে তাহলে তাকে বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে যাতে করে অন্য কোন শিশু তাকে দেখে উৎসাহিত হয়ে নতুন করে পথশিশুর তৈরি হতে না পারে। সেদিকে সব সময় নজর রাখতে হবে সবাইকে। যে এলাকায় দেখা যাবে ঐ এলাকার জনগণকে তা করতে হবে, তা নাহলে পথশিশুর রোধ করা বা নির্মূল করা কিছুতেই সম্ভব হবে না। এজন্য প্রয়োজন সকল মানুষের ঐক্যবদ্ধ সহযোগিতা এবং এদের প্রতি কর্তব্যবোধ অনুভব করার মানসিকতা।
সুবিধাবঞ্চিত শিশুরা পথশিশু বা টোকাই আর এই টোকাইদের সম্পর্কে আমাদের রাষ্ট্রনীতি অন্ধ ও বয়রা। কেননা রাষ্ট্রনীতি এদের দেখেও না, এদের কথা শুনেও না। রাষ্ট্রপ্রধান হয়তো জানেনই না তাঁর দেশের এই সমস্যা কথা, কিংবা জেনেও না জানার মত আছেন তাই সমাধানের কোনো নীতিমালা গ্রহণ করছেন না। কেন জানি এদেরকে সমস্যা বলে মনে করছেন না, এ সমস্যার সমাধান করা উচিত বলেও ভাবছেন না। কিন্তু আজ বড় প্রয়োজন এমন নীতিমালার যে নীতিমালায় বঞ্চিত শিশুদের জন্য সুফল বয়ে আনবে। এই শিশুদের কল্যাণে প্রয়োজন একটি পূর্ণাঙ্গ সুষ্ঠু নীতিমালার অথচ কোনো নীতিমালা নেই, থাকলেও উদ্যোগ নেই বাস্তবায়নের। সুষ্ঠু নীতিমালা গঠন এবং বাস্তবায়ন করে এসব শিশুদের মানুষ করতে পারলে হয়তো আর পথশিশু বা টোকাই তৈরি নাও হতে পারে। নাকি সরকার ভাবছে এদের মানুষ করলে রাস্তার জঞ্জাল পরিষ্কার করবে কে, তারা তো রাস্তার জঞ্জাল টুকায়, তাই তারা টোকাই।
দিনের পর দিন ড্যান্ডি নেশা করে আর রাস্তার টোকানু খাবার খেয়ে এই শিশুগুলোর শরীরে পুষ্টি বলতে কিছুই নেই। এদের চোখ-মুখ-পা ফোলা দেখলে মনে হয় সারা শরীরে পানি এসেছে। এই শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত। সারাদিন ঝুমতে থাকে, চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে একটা আরেকটার উপর। খুব একটা ছোটাছুটি করতে দেখা যায় না, হয়তো ছোটাছুটি করার মত শক্তি এদের গায়ে নেই; থাকার কথাও না। না খেয়ে শুধু নেশা করলে কি গায়ে শক্তি থাকে। খেয়ে না খেয়ে অনাদরে আর অবহেলা তাদের দিন কাটে। সুষ্ঠু ভাবে বিকাশ লাভের জন্য খাদ্য, চিকিত্সা, শিক্ষা পাওয়ার তাদের মৌলিক অধিকার। ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এই পথশিশুদের জীবনযাপন অত্যন্ত কষ্টদায়ক।
যারা এই ড্যান্ডি বা গামবেল্ডিং বিক্রি করে মানে যে সব দোকানে বিক্রি করে ঐসব দোকানের মালিকদেরও কিন্তু দেশের প্রতি এই শিশুদের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যায়। তারা যদি এই ছোট্ট কোমলমতি শিশুদের কাছে ড্যান্ডি বিক্রি না করত তাহলে এরা কিছুটা হলেও বাধাগ্রস্ত হতো, কেননা এদের পেতে একটু হলেও কষ্ট হতো। তারা যদি বিক্রি করলেই লাভ এই মনোভাব নিয়ে ব্যবসা করে তাহলে মানুষ হিসেবে তারা গণ্য হতে পারে না। তাদের উচিত তারা সংঘবদ্ধ হয়ে মালিক সমিতির মাধ্যমে শিশুদের কাছে শুধু ড্যান্ডিই না ক্ষতিকারক বা নেশা হয় এমন কোন দ্রব্য বিক্রি না করা। এটা ব্যবসায়ীদের নৈতিকতার মধ্যে পরে। আর দেশের সরকারের উচিত এ ধরনের পণ্য বিক্রেতাদের উপর কিছু নিষেধাজ্ঞা কিংবা নীতিমালা বেঁধে দেয়। তারা যেন শিশুদের হাতে নেশা হয় এমন পণ্য বিক্রির নাম করে তুলে না দেয়।
সাধারণ জনগণেরও কর্তব্য নেশাগ্রস্ত পথশিশুদের নেশা মুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা। এটা এলাকা ভিত্তিক করা যেতে পারে, প্রতিটা এলাকায় পথ শিশুদের নেশার বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা দরকার। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তির্বগ ওয়ার্ড কমিশনার কিংবা মেম্বার সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন কিভাবে এই পথ নেশাগ্রস্ত শিশুদের প্রতিকার করা যায়। সেই ব্যবস্থা তারা করতে পারেন, এটা সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমরা যারা সাধারণ মানুষ পথে-ঘাটে চলাফেরা করি, আসুন না আমার অন্তত বাধা দেওয়া বাধা দেয়ার চেষ্টা করি। শিশুদের হাতে দেখলে আমরা ওদের হাত থেকে নিয়ে নেই কিংবা পরিস্থিতি বুঝে যখন যা করা যায় করার চেষ্টা করে। পরিশেষে বলব সব দায়-দায়িত্ব দেশের সরকারের। সরকার ভালো জানেন তার দেশের সমস্যা কিভাবে সমাধান করবে। কিন্তু করতে হবে অবহেলা করলে চলবে না, করবো করবো করে সময় পার হলে চলবে না; যতটা সম্ভব দ্রুত করা উচিত। এই সমস্যার সমাধান করতে সরকারকে খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতে হবে না। কারণ এরা শিশু তার ওপর পথশিশু। এরা খুবই দুর্বল একটু আদর স্নেহ পেলে সঠিক পথে ফিরে আসবেই, শুধু পথ ভুলিয়ে আনার উদ্যোগ দরকার।
মধুমিতা সিনেমা হলের পেছনে একটি ছেলে বয়স দশ এগারো বছর হবে নাম রুবেল। রুবেলের হাতে পেস্টিং লাগানো পলিথিন দেখে জিজ্ঞেস করি কাগজের ভিতরে কি আছে। কেন খায় প্রশ্ন করাতে রুবেল বলে খাই না, শ্বাস নেই। কাগজে কি লাগানো, আমাকে দেখাবে বলার সাথে সাথে ওর প্যান্টের পকেট থেকে কৌটা বের করে। আমি হাতে নিয়ে দেখতে চাইলে দিতে চায় না; আমি নিব না বলতে কিছুটা বিশ্বাস করে আমার হাতে দেয়। আমি কৌটা প্রথম দেখলাম ফিরিয়ে দিলাম জিজ্ঞেস করলাম কেন শ্বাস নেই; রুবেল উত্তর দেয় ভালো লাগে। এই ভালো লাগা থেকে একে একে নেশায় আক্রান্ত হচ্ছে সব পথশিশুরা।
শুধু আমাদের দেশের মানুষদেরই না যেসব দেশে এই পথশিশু আছে ঐসব দেশের মানুষদেরও বলছি আপনারা এই পথশিশুদের দিকে নজর দিন, এদের শিক্ষা আলো দিয়ে মানুষের মত মানুষ করে গড়ে তোলুন। অবহেলিত এই পথশিশুরাই হতে পারে জাতির মূল্যবান সম্পদ। এরা আপনার আমার সন্তানের মত মানুষ; সামান্য আঘাতে ব্যথা পায়, কষ্ট পায় ক্ষুধার তাড়নায়, অসুস্থতায়। চায় একটু আদর স্নেহ ভালোবাসা। সামান্য কিছু দিয়ে যদি বিরাট কিছু পাওয়া যায় তাহলে আসুন আমরা আপনার বিশেষ সবাই মিলে পৃথিবীর সব পথশিশুদের দায়িত্ব ভাগ করে নেই যার যার জায়গা কিংবা অবস্থান থেকে। হাত মিলান বিশ্ববাসী, সবাই মিলে পথশিশুদের জীবন আলোয় ভরে তুলি।
এই দায় আমিও এড়াতে পারি না, আমারও দায় আছে। পৃথিবীর প্রতি, দেশের প্রতি এবং সমাজের প্রতি; একজন মানুষ হিসেবে মানুষের প্রতি, নারী হিসেবে সন্তানের প্রতি। আর এই দায়িত্ববোধ থেকে দু’কলম আমার এই লেখা। আমার এই লেখার মাধ্যমে ঘুমন্ত সমাজের চোখে আদর্শকে, মানবতাবোধকে, বিবেককে জাগিয়ে তোলা। বিশ্বের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তের প্রতিটা মানুষের ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়া।
আমার পরবর্তী লেখা – সন্তান যাই হোক তবু আমি “মা”
No comments:
Post a Comment