বৃদ্ধটি কি সমাজসেবা অধিদফতর কর্মসূচির আওতাধীন?
মানুষ!মাত্র তিনটি বর্ণের সমন্বয়ে একটি শব্দ। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব এই মানুষ। মানুষকে সৃষ্টিকর্তা কত সুন্দর করেই-না ভাল-মন্দ বুঝার অনুভূতি দিয়ে তৈরি করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। পৃথিবীটাকে কত সুন্দর করে গড়েছেন শুধুমাত্র মানুষের জন্য। মানুষের সুখের জন্য, আনন্দের জন্য। কিন্তু হায়রে মানুষ এওকি সৃষ্টির বিধান। কেউ থাকে রাজপ্রাসাদে, রাজমহলে, কেউ থাকে পথে-ঘাটে কেউ থাকে নরম গালিচায় কেউ থাকে ফুটপাতে, আইল্যান্ডে কিংবা ঠেলায়, বেনে।
ফুটপাতে মানুষের জীবন-যাপন সাধারণ সব মানুষের মত আমিও দেখতাম এইটুকুই ব্যাস! আগে কখনো খুব কাছ থেকে আবেগ দিয়ে এতটা খেয়াল করে দেখিনি। এখন জীবনের তাগিদে কঠোর পরিশ্রম করতে গিয়ে দিন-রাত পরিশ্রম করছি আর সেই সুবাদে অনেক কিছু দেখছি এবং উপলব্ধিও করছি।
প্রতিদিন সকালে কাজের উদ্দেশ্যে যখন বাসায় থেকে বের হই তখন অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিসের প্রয়োজন ভেবে অভাব-বোধ করে কষ্ট পাই আবার যখন মতিঝিলে ফুটপাতে, আইল্যান্ডে, ভেনে ইত্যাদি-ভাবে প্লাস্টিক কিংবা পাটের বস্তা গায়ে দিয়ে কেউ ইট-পাথর জাতীয় শক্ত কিছু উপর মাথা রেখে কিংবা শুধু মাটিতেও কয়েকজন জড়ো হয়ে কি সুন্দর করে ঘুমোচ্ছে দেখি; তখন নিজেকে নিজেই সান্ত্বনা দেই, কত সুখে আছি! রাতেও একই অবস্থা এতো কোলাহলের মধ্যে তাদের ক্লান্ত দেহটাকে কোথাও এলিয়ে দেয়ার জয়গাও মেলে না। অপেক্ষা করতে থাকে কখন শহর কোলাহল থেমে নীরব হবে আর কখন ক্লান্ত অবসন্ন শরীরটা লুটে পড়বে মাটিতে।
একদিন মতিঝিলে এক বৃদ্ধ সম্ভবত অসুস্থ ঘুমানোর জন্য বৃদ্ধ লোকটা চেষ্টা করছে বলেই মনে হলো কিন্তু ঘুমাতের পারছে না পাশেই ফুটপাতে কাঁচা বাজার, যানবাহনের শব্দ তো আছেই, বুঝতেই তো পারছেন বৃদ্ধর অবস্থা। এই অসুস্থ বৃদ্ধ লোকটা না পারছে কাউকে কিছু বলতে না পারছে সাইতে। নিজের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে সে যে কিরকম কিট-মিট করছিল না দেখে কেন দেখেও বুঝার চেষ্টা না করলে বুঝা যাবে। পর পর কয়েকদিন এপথ দিয়ে লোকটাকে দেখে গেলাম এরই মধ্যে একদিন প্রচণ্ড বৃষ্টি হলো। উপরে ফাঁকা, তিনদিক ফাঁকা শুধু একদিকে বিল্ডিং এমনভাবেও যে অসুস্থ বৃদ্ধ মানুষ বেঁচে থাকতে পারে ভাবা যায়? কয়েক দিন এপথে যাতায়াত করিনি তারপর আবার যখন ঐ পথে গেলাম বৃদ্ধ মানুষটিকে দেখতে পেলাম না; কোথায় গেল, বেঁচে আছে না মারা গেল জানতে পারলাম না। তখন আমার কাছে ক্যামেরা না থাকায় ছবি তুলতে পারিনি।
মানুষ কতটা কষ্টে কতটা নিরুপায় হয়ে জীবন-যাপন করছে আমরা কি কখনো ভাবি। বনের পশু-পাখীদেরও নিজস্ব ঘর আছে, শেয়াল-কুকুরেরও একটা আস্থানা আছে, সন্ধ্যা হলে নীড়ে ফিরে, ঝড়-বাদলে আপন ঘর আঁকরে ধরে বাঁচার চেষ্টা করে। পথের ধারের বা ফুটপাতের এই মানুষগুলোর তো তাও নেই। এতো গেল আশ্রয়ের কথা এবার আসি খাওয়ার কথায়।
আশরাফুল মাকলুকাত। অর্থাৎ সৃষ্টির সর্বশ্রেষ্ঠ জীব হলো মানুষ। মানুষ আবার কয়েক শ্রেণীতে বিভক্ত, সামাজিক শ্রেণী বৈষম্য অনুসারে। আমার মতে মানুষ দুই শ্রেণীতে বিভক্ত। এক শ্রেণী খেয়ে শেষ করতে পারে না বলে নষ্ট করে ডাস্টবিনে ফেলে দেয়, আরেক শ্রেণী ঐ না খেতে পেরে নষ্ট করে ফেলে দেয়া খাবার কুঁড়িয়ে খায় ডাস্টবিন থেকে। অথচ সব মানুষ একই উপাদানের তৈরি এক পৃথিবীতে বাস, কষ্টের অনুভূতিও এক, আঘাত পেলে সবাই বলে ওঠে মা-গো।
আমরা সব সময় উপরের দিকে তাকাই বলে আমাদের এত তৃষ্ণা এত হাহাকার, কখনো নীচের দিকে তাকাই না। যারা এইভাবে বেঁচে আছে না থাকার বিকল্প ব্যবস্থা নেই বলেই বেঁচে আছে, যেভাবে হোক, যেখানেই হোক, যা খেয়েই হোক। তাও বোধহয় সৃষ্টিকর্তারই কৃপা।এই মানুষগুলোর যেমন সভা-সমাবেশ নেই, রাজনীতি নেই, নেই কোন মন্ত্রণালয়। হয়তো নাম আছে ভোটার লিস্টের খাতায়, শুধু প্রয়োজন পরে না ভোটা দেওয়া।
ছবিটি নটরডেম কলেজের সামনের থেকে তুলা। এই বৃদ্ধ লোকটি আজ প্রায় দুই বছর হবে ফুটওভার ব্রীজের ৪টি স্তম্ভের মাঝখানের জায়গাটুকুতে বাসস্থান বানিয়ে জীবন কাটাচ্ছে। পায়খানা প্রস্রাব এখানে করছে, কখনো কখনো দেখা যায় সারা গায়ে নোংরা ময়লা লেগে থাকায় গায়ে মাছি বসে বনবন করছে। পাশে দিয়ে যাওয়া যায় না দুর্গন্ধে। বৃদ্ধটির ভিতরে এখনো প্রাণ আছে, বৃদ্ধটির একটি জীবিত মানুষ কিন্তু পৃথিবীর এই বুকে মানুষ নামক এই প্রাণীটি রোদ-বৃষ্টি-ঝড়-তুফানে পরে আছে খোলা ময়দানে।
এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন বড় বড় আমলা, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, ধনী ব্যক্তিরা। কে যায় না এই পথ দিয়ে কারো চোখে কি এই বৃদ্ধকে চোখে পড়ে না কিংবা সাধারণ মানুষের একবারও কি মনে হয় এই প্রাণীটি একটি মানুষ। পথে ঘাটে পড়ে থাকা মানুষদের নিয়ে ভাবেন কি আমাদের দেশের দেশ প্রধানরা। সবই হচ্ছে, হচ্ছে না শুধু এই শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে সংসদের কোন আলোচনা। তাদের জন্য বাজেট হচ্ছে না, অর্থ বরাদ্দ হচ্ছে না।
দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম বয়োজ্যেষ্ঠ অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে ও পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে প্রবর্তন করা হয় বয়স্ক ভাতা। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সমাজসেবা অধিদফতর এই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে থাকে। এই বৃদ্ধ মানুষটি বা এরকম বৃদ্ধ-জনেরা কি সমাজসেবা অধিদফতর এই কর্মসূচির আওতাধীন?
No comments:
Post a Comment