Pages

ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য

ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য



ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য



আজ আমরা বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছি। এখন আমাদের জীবনে শুধু দিন যায় রাত আসে, রাত যায় দিন আসে। ব্যস্ততায় অতিক্রান্ত হয় সময়ের সীমানাগুলো। কর্ম-মুখরতায় যে জীবন বিকৃত সেখানে চারদিকে তাকানোর কোন সুযোগ থাকে না, ব্যস্ততাই যে জীবনের বৈশিষ্ট্য। প্রকৃতি অপরূপ সৌন্দর্য, জ্যোৎস্না রাত কিংবা আকাশের চাঁদ-তারা দেখে সময় কাটানোর সময় কই। একটু ফুসরত পেলেই এই যান্ত্রিকতার ক্লান্তি দূর করতে ভিতর থেকেই তাগিদ আসে কোলাহল ছেড়ে কোন এক নির্জনতায় ছুটে যেতে।


শান্ত স্নিগ্ধ সবুজ বন-বনানী, পাহাড়-টিলা, জলধারার শান্ত জল আর আঁকা বাঁকা মেঠো পথ এই বিস্তীর্ণ এলাকাটিকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের আকর আর পরম আকর্ষণীয়। এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চমৎকারভাবে প্রত্যক্ষ করা যায় বিচিত্র রূপে ভিন্ন আমেজে। এখানকার প্রতিটি দৃশ্য সমুজ্জ্বল। প্রকৃতিকে অপরূপ সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করাই যেন মেঠো পথ, পাহাড়, বনানী আর জলধারার কাজ।
ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য



এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের যে অনবদ্য প্রকাশ ঘটে তা মানুষের মনের উপর বিচিত্র প্রভাব সৃষ্টি করে। প্রকৃতি নানারূপে মানুষের মন নাচিয়ে তুলে, মাতিয়ে তুলে অবসন্ন দেহ, মনে আনে নানা রং-বেরং এর স্বপ্ন। মানুষের মনের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা প্রকৃতির সৌন্দর্য ও রুদ্র রূপের মধ্যে যেন প্রতিফলিত হয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ রুদ্র ও তার স্নেহে লালিত মানুষ জীবনের দীনতাকে সৌন্দর্যের চেতনায় উপভোগ্য করে তুলতে এবং সব প্রতিকূলতাকে সংগ্রামী চেতনায় গ্রহণ করতে সক্ষম করে তুলে।

দিনের ক্লান্তি শেষে সন্ধ্যা আসে শান্তির ললিত বাণী নিয়ে। দিনের জীবন কাজের জীবন-কর্ম-মুখরতায় সে জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত মুখরিত। কিন্তু এই কর্মচাঞ্চল্য থেকে একসময় সবাইকে বিদায় নিতে হয় বিশ্রামের জন্য। কর্মব্যস্ত মানুষের জীবনের মতো এখানকার প্রকৃতিও যেন একই নিয়মে চলে, প্রকৃতিতে শুরু হয় আলোছায়ার খেলা। সূর্যের আলো কমতে থাকলে গাছের মাথায় তার কারুকাজ ফুটে ওঠে। ক্রমেই পশ্চিম আকাশে সূর্য লাল হয়ে ওঠে দিনের বিদায়ের ইঙ্গিত জানায়, ক্রমে ম্লান হয়ে আসে আলোর রেখা। হাল্কা আঁধার ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। দূরের দৃশ্যাবলী ক্রমে অস্পষ্ট হতে থাকে একসময় আঁধারের সঙ্গে মিশে একাকার হয়ে যায়। এই দৃশ্য এক অপূর্ব দৃশ্য। প্রকৃতি তখন কিছুক্ষণের জন্য হলেও মানুষকে সংসার জগতের মোহ ভুলিয়ে দেয়।
এসব মায়াময় সৌন্দর্য গোধূলির অপরূপ ঐশ্বর্য বলে বিবেচিত হয়। নির্জন প্রকৃতির মধ্যে সন্ধ্যার আগমন ঘটে বলে সেই নির্জনতার সুযোগে এসব দৃশ্য আরও উপভোগ্য হয়ে ওঠে। সন্ধ্যার প্রাক্কালে প্রকৃতির দৃশ্য যেন বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেখা দেয়। ক্রমে ক্রমে নির্জনতা রূপটি প্রত্যক্ষ করা যায়। সন্ধ্যায় এখানে পরিবেশে যে নিস্তব্ধ রূপ নিয়ে আসে তা যেন মানুষকে এক স্বতন্ত্র জগতে নিয়ে যায়। জীবনের রূপ ভেতর থেকে সন্ধান করার সুযোগ এনে দেয় এখানে সন্ধ্যা। তাই এখানকার গোধূলি কখনো কখনো কোন কোন মানুষের জীবনকে অতীত-বর্তমানের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।

ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্যরাতের পৃথিবী কর্মহীন পরিশ্রান্ত হয়ে ঘুমিয়ে থাকে। এই রাতে যে এমন সৌন্দর্যের ঐশ্বর্য সমারোহ ঘটাতে পারে তা এখানকার প্রকৃতি না দেখলে উপভোগ করা যাবে না। রাতের এই অনাবিল মনোরম সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলে রাত ফুরিয়ে যাবে তবুও নিজেকে খুঁজে পেতে ইচ্ছা করবে না। সব মিলে এখানকার প্রকৃতির লীলা খেলার এক বিচিত্র প্রকাশ।

আমি এতক্ষণ যে প্রকৃতির সৌন্দর্যের প্রতীক ও সৌন্দর্যের অপরূপ মহিমার কথা বলে গেলাম সেই জায়গাটির নাম এখনও বলা হলো না, জায়গাটি হল ফয়’স লেক। যারা প্রকৃতি প্রেমিক তাদের জন্য তো বটেই আর যারা সংসার জীবনের কর্মব্যস্ততায় নানা জুট-ঝামেলায় হাঁপিয়ে উঠে একটু স্বস্তি চাচ্ছেন কিংবা কিছুক্ষণের জন্য হলেও ভুলে যেতে চাচ্ছেন সংসার জীবনের জটিলতা তাদের জন্য ফয়’স লেক এক অপূর্ব জায়গা। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করার জন্য ফয়’স লেকের বিকল্প নেই।
হ্রদ ও পাহাড়ের কোলে গড়ে উঠেছে চট্টগ্রামের বিনোদন কেন্দ্র ফয়’স লেক। যা হাতছানি দেয় প্রকৃতি-প্রেমীদের। একদিকে ছোট বড় টিলা আর পাহাড়, অন্যদিকে নীল জলরাশি মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রশান্তি এনে দেয়। নৈসর্গিক সৌন্দর্য-মণ্ডিত এ প্রকৃতির কাছে ছুটে যায় কর্মব্যস্ত মানুষ। পাহাড়ঘেরা সবুজ বনানী আর স্বচ্ছ জলধারা নিয়েই জন্ম হয়েছিল ফয়’স লেক। ফয়’স লেকের পাহাড়ি এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সত্যিই মনোমুগ্ধকর। প্রাকৃতিক নৈসর্গিক সৌন্দর্যের ফয়’স লেক তুলনা হয়। পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে পশ্চিম আকাশে বঙ্গোপসাগরের বুকে সূর্যাস্ত মনোরম দৃশ্য এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আঁধার এই স্তম্ভটি প্রকৃতি-প্রেমীদের সব সময় কাছে টানে।
ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য

যে লেকটি এক সময় পাহাড়তলী লেক হিসেবে পরিচিত ছিল সেই লেকটি আজ ফয়’স লেক নামে পরিচিত। ফয়’স লেক দেখে প্রাকৃতিক মনে হলেও আসলে লেকটি কৃত্রিম জলধারা। চট্টগ্রামের পাহাড়তলী রেলস্টেশনের অদূরে খুলশি এলাকায় এবং জিরো পয়েন্ট থেকে আট কিলোমিটার দূরে এই জলধারাটি অবস্থিত। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে চট্টগ্রামস্থ তৎকালীন আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে কোম্পানির হেডকোয়ার্টারের আবাসিক এলাকায় পানি সরবরাহের জন্য রেলওয়ে 336.61 একর জায়গায় প্রায় 400 ফুট দীর্ঘ বাদ দিয়ে কৃত্রিম লেক সৃষ্টি করা হয়। আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে তৎকালীন প্রধান প্রকৌশলী “মিস্টার ফয়” ব্রিটিশ নাগরিকের পরিকল্পনা অনুযায়ী জলধারাটি নির্মিত হওয়ায় প্রকৌশলীর নামে নামকরণ করা হয়।

লেকটি পাহাড়ের এক শীর্ষ থেকে আরেক শীর্ষের মধ্যবর্তী একটি সংকীর্ণ উপত্যকায় আড়াআড়িভাবে বাঁধ দিয়ে সৃষ্টি করা হয়। আড়াআড়িভাবে নির্মিত বাঁধটি চট্টগ্রাম শহরের উত্তর দিকের পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে আসা পানির প্রবাহের দিক পরিবর্তনের মাধ্যমে লেকটি সৃষ্টি করা হয়েছে। ফয়’স লেকের তোরণ খুলশি এলাকার প্রধান সড়কের পাশে। সেখান থেকে কিছুটা ভেতরে এর মূল প্রবেশ পথ। শুরুতেই ফয়’স লেকের অ্যামিউজমেন্ট ওয়ার্ল্ড।

ছোট পাহাড় আর টিলার বাঁকে বাঁকে বিস্তৃত এই পর্যটন কেন্দ্র সব মিলে এক অন্য রকম ভালো লাগার জন্ম দেয়ার পরিবেশ। এ অঞ্চলের চারদিকে পাহাড় আর মাঝখানে রয়েছে অলকানন্দা, আকাশমনি, গোধূলি, মন্দাকিনী, দক্ষিনী, অরুনাময়ী নামের হৃদ। এই লেকে দেখার মতো রয়েছে অনেক কিছু আর দেখানোর জন্য রয়েছে হৃদের পাড়ে সারি সারি নৌকা। দুই দিকে সবুজ পাহাড় আর নানা রকম পাখি। এই মনোরম পরিবেশে অন্যরকম ভালোলাগা হচ্ছে হরিণের বিচরণ। পর্যটক আকর্ষণ করার জন্য ফয়’স লেক প্রবেশ পথে স্থাপন করা হয়েছে ছোট চিড়িয়াখানা। পর্যটকদের মনে দোলা দেয় ফয়’স লেকের পার্শ্ববর্তী পাহাড় ও প্রাকৃতিক পরিবেশের সৌন্দর্য।
ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য



এই লেকটি দীর্ঘ সময় অবহেলায় অযত্নে পড়ে থাকায় একসময় জৌলুশ হারাতে বসেছিল। ফয়’স লেকের প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ২০০৫ সালে সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও রিসোর্ট। চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে উঁচু পাহাড় বাটালি হিলটি ফয়’স লেকের পাশে। একদিকে নীল জলরাশি, অন্যদিকে ছোট বড় টিলা আর পাহাড়। কৃত্রিমভাবে তৈরি হলেও এখানে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মানুষকে ক্ষণিকের জন্য হলেও প্রশান্তি এনে দেয়।

ফয়’স লেকে একটি চিত্তবিনোদন পার্ক খোলা হয়েছে। নাটুকে হাঁটার পথ, ল্যান্ডস্কেপিং, লেকে নৌকায় ভ্রমণ, ভাসমান ধাপ কনসার্ট, রেস্টুরেন্ট ও আরও অনেক উপভোগের জিনিস রয়েছে। হ্রদটির হৃদয়কারা দৃশ্য উপভোগের জন্য নৌকাভ্রমণে যেতে পারেন। চিত্তবিনোদন পার্কে উচ্চ গতির রোলার কোস্টার ও বাম্পার বোট দু’টি স্লাইড আছে। চট্টগ্রামের হৃদয়ে অবস্থিত ফয়’স লেকের একটি জল থিম পার্ক। স্প্লাশ পুল, ওয়াটার কোস্টার রাইডার এবং বিশ্বমানের থিম পার্ক হিসেবে যা যা আশা করা যায় তার সবই সি ওয়ার্ল্ডে আছে। চট্টগ্রাম শহরের সিটি গেট সংলগ্ন সড়ক দিয়ে গেলে সরাসরি প্রবেশ করা যাবে সি ওয়ার্ল্ডে। তবে মূল প্রবেশ পথে সি-ওয়ার্ল্ডে গেলে নৌকায় চড়ে পৌঁছুতে হয় সি ওয়ার্ল্ডে। এখানে আধুনিক ওয়াটাপার্কের বিভিন্ন রাইড আছে।

বেশ কিছু আধুনিক রাইড আছে এখানে। জায়ান্ট ফেরিস হুইল, ড্রাই স্লাইড, সার্কাস সুইং, ফ্যামিলি ট্রেইন, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, ফ্যামিলি রোলার কোস্টার, পাইরেট শিপ, প্যাডেল বোট, ফ্লোটিং ওয়াটার প্লের মত আনন্দদায়ক রাইড। এখানে টিলাগুলোর উপরে আছে বনভোজন কেন্দ্র, পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। এগুলো একেকটা একেক টিলার উপরে। এখান থেকে চট্টগ্রাম শহরের বার্ডস আই ভিউ দেখা যায়।

প্রকৃতির মাঝে নির্জনতায় অবকাশ যাপনের জন্য ফয়’স লেকে আছে বেশ কিছু রিসোর্ট। সি-ওয়ার্ল্ডের পাশেই এর অবস্থান। রিসোর্টেও যেতে হয় নৌকায় চড়ে। নির্জনতায় সময় কাটানোর জন্য আদর্শ জায়গা এসব রিসোর্ট। লেক ও পাহাড়মূখী দু’ধরনের ঘরই আছে এখানে। বারান্দায় বসে লেক আর পাহাড়ের সৌন্দর্য উপভোগের ব্যবস্থাও আছে।
ফয়’স লেকের নীল জলরাশি ও অনাবিল মনোরম সৌন্দর্য
ফয়’স লেক সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় তিনশ ফুট উঁচু এ লেকে বছরের সবসময়ই কানায় কানায় জলে পূর্ণ থাকে। চারিদিকে ছোট ছোট পাহাড়ের ফাঁকে ফাঁকে ছড়িয়ে আছে এই লেকের জলরাশি। ফয়’স লেকে পৌঁছাতেই হিমেল বাতাসের পরশ লাগে। হ্রদের পাড়ে যেতেই দেখা মিলবে সারি সারি স্পিড-বোট। সাগর-পাহাড় আর প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য চট্টগ্রামকে করেছে ভৌগোলিকভাবে সমৃদ্ধ। এ সৌন্দর্য উপভোগ করতে অনেক প্রকৃতি পিপাসুক ছুটে আসেন এখানে।

আঁকাবাঁকা হ্রদের ঝোপ-জঙ্গলে হারিয়ে যাওয়া যায় অনায়াসে প্যাডেল বোট নামক বৈঠা-বিহীন নৌকা নিয়ে। পাহাড়ের খাঁজ বেয়ে লেকের পাড় ধরে অরণ্যে বেড়ানোর রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা যায় এখান থেকে। বোটে চড়ে লেকের স্বচ্ছ নীল জলে পথ পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে। ক্যাবল কারে লেক এলাকার এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে যাতায়াত করা যায়।

অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্পর্শে ফয়’স লেক এখন অনেকটা বদলে গেছে। স্বচ্ছ নীল জলরাশি আর সবুজ অরণ্যের শিহরণ জাগানো নীরবতা এখনো হাতছানি দিয়ে ডাকে, সে হল ফয়’স লেক। ফয়’স লেক সত্যিই সুন্দর। প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্য দুই-ই উপভোগ করা যায় ফয়’স লেকে। পাহাড়ের কোলে স্বচ্ছ লেক, লেকের ধারে কুটির, জলযান সব কিছুই আকর্ষণীয় ও মনোমুগ্ধকর।



No comments:

Post a Comment