প্রাণ ভরে দেখতে মন ভরে খেতে ব্যাগ ভরে নিতে চলে আসুন নরসিংদীতে
নরসিংদীর বিলুপ্ত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনল লটকন
নরসিংদীর মানুষ তাই সত্যিই ভাবতে ভাল লাগে, ফিরে এলো নরসিংদীর বিলুপ্ত ঐতিহ্য আর ফিরিয়ে আনল লটকন। নরসিংদীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে লটকন ফলের বাগান। গাছের গোঁড়া থেকে শুরু করে আগা-ডগা পর্যন্ত ঝুলে থাকে থোকা থোকা লটকন। লটকন যখন কাঁচা থাকে তখন সবুজ হয়ে যায় নরসিংদী আবার লটকন পাকলে হলুদ রং-এর (পাকা লটকন) একাকার হয়ে যায় এই অঞ্চল; এ এক অপূর্ব দৃশ্য।
কাঁচা-পাকা যাই হোক লটকনের মৌসুমে এই অঞ্চলে যতদূর চোখ যায় শুধু লটকন আর লটকন। লটকনের মৌসুমের ফল প্রেমিকরা ছুটে যায় নরসিংদীর লটকন বাগানে। তখন আগত অতিথিদের ভিড়ে গমগম করে নরসিংদীর রায়পুরা, বেলাবো ও শিবপুরে। সত্যিই লটকন ফিরিয়ে আনল নরসিংদীর বিলুপ্ত ঐতিহ্য।
কাঁচা-পাকা যাই হোক লটকনের মৌসুমে এই অঞ্চলে যতদূর চোখ যায় শুধু লটকন আর লটকন। লটকনের মৌসুমের ফল প্রেমিকরা ছুটে যায় নরসিংদীর লটকন বাগানে। তখন আগত অতিথিদের ভিড়ে গমগম করে নরসিংদীর রায়পুরা, বেলাবো ও শিবপুরে। সত্যিই লটকন ফিরিয়ে আনল নরসিংদীর বিলুপ্ত ঐতিহ্য।
বৈজ্ঞানিক নাম Baccaurea motleyana, ইংরেজি নাম Burmese grape, বাংলাদেশের স্থানীয় অনেক নাম লটকন বা লটকা। ফলটি Phyllanthaceae পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। লটকনের আদি বাস পশ্চিম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।কাচা অবস্থায় সবুজ পাকলে হলুদ বর্ণ ধারণ করে, ফলটি ছোট আকৃতি, র্মাবেলের মত গোলাকার; ফলের খোসা পুরু ও নরম। পাকা লটকনের উপরের রং হলুদ ভিতরে খাদ্য অংশটুকু সাদা আর বীচি অনেকটা মেরুন কালারের। আকারে ছোট ফলটি দেখতে খুবই সুন্দর। প্রতি ফলে দুই থেকে চারটি করে বীজ থাকে। লটকন খোসা ফেলে সরাসরি খেতে হয় তবে জ্যামও তৈরি করা যায়। লটকনের বীজের গায়ে যে রসালো অংশ থাকে ঐ রসালো অংশটুকুই ভক্ষণীয়। লটকন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন নামে পরিচিত তাই লটকনের অনেকগুলো নাম। নামগুলো হল লটকল, লটকা, লটকো, নটকো,বুবি, বুগি হাড়ফাটা, ডুবি, কানাইজু, লটকাউ, কিছুয়ান ইত্যাদি।
প্রায় ৩০ বছর আগে প্রথম অপ্রচলিত জংলি ফল লটকনের চাষ শুরু হয় নরসিংদী জেলার বেলাবো উপজেলার লাখপুর গ্রামে। জংলি ফল লটকন চাষের শুরু থেকেই কৃষকরা লাভবান হওয়ায় কৃষকদের লটকন চাষের প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। এরপর বেলাবো ও শিবপুর উপজেলার লালমাটির এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নে লটকন চাষ শুরু এবং অতিদ্রুত লটকন চাষের প্রসার ঘটতে থাকে। বিশেষ করে গত ৩০ বছরে শিবপুর ও বেলাবো উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। নরসিংদীতে লটকন চাষের মাধ্যমে অনেকেই বেকার সমস্যা দূর করে নিজেদের ভাগ্যের চাকা ঘোরায়। বর্তমানে লটকন ফল এই দুই উপজেলার প্রায় প্রত্যেক পরিবারের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি।
বর্তমান ইন্টারনেট যুগে বিভিন্ন মাধ্যমে জানার সুযোগ পেয়ে মানুষ এখন সব দিক দিয়ে অনেক সচেতন। এখন মানুষ সব চেয়ে বেশি সচেতন হচ্ছে স্বাস্থ্য সম্পর্কে। মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা বৃদ্ধির ফলে একসময়ের জংলি লটকন আজ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল লটকনের এত চাহিদা ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। ব্যাপক চাহিদা ও জনপ্রিয়তার বাড়ার সাথে সাথে লাভজনক ফসলে পরিণত হওয়ায় লটকনের আবাদ বেড়েই যাচ্ছে নরসিংদীতে। গাছে গাছে ঝুলছে থোকা থোকা লটকন। মে থেকে আগস্টের মাঝামাঝি পর্যন্ত লটকন ভরা মৌসুম তখন নরসিংদীতে শুধু লটকন আর লটকন। লটকনের রাজ্য হচ্ছে নরসিংদী।
কয়েক বছর আগেও বনে-জঙ্গলে ও বাড়ির আঙ্গিনায় দেখা যেত কিছু বন্য লটকন গাছ। কয়েক বছরের ব্যবধানে আজ লটকন ফলের বড় বড় বাগানে ছেয়ে গেছে নরসিংদী জেলার রায়পুরা, বেলাবো ও শিবপুর উপজেলা। অপ্রচলিত এই লটকনের বাণিজ্যিকভাবে চাষ তো দূরের কথা দু’একটা লটকন গাছ লাগানোর কথাও ভাবতেন না এখানকার কৃষকরা। কালের বিবর্তনে লটকন আজ জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানীয় সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফল। সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ ফলের চাহিদা দ্রুত এবং অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ায় এখানকার কৃষকরা বাণিজ্যিকভাবে লটকন ফলের চাষ করেন এবং বড় আকারের লাভবান হন অর্থনৈতিকভাবে। নরসিংদীর অনেক কৃষক লটকন চাষ করে অর্থনৈতিক সফলতা অর্জন করেছেন।
নরসিংদীর সাগর কলার বিলুপ্ত ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনল লটকন। অনেকের পছন্দের ফল লটকন। পৃথিবীর সবচেয়ে স্বাদের লটকন হয় নরসিংদী জেলার শিবপুর উপজেলায়। নরসিংদীর লটকনের স্বাদেরও সুনাম আছে বিশ্ব জুড়ে। তাই-তো দেশের চাহিদা মিটিয়ে ২০০৮ সালে নরসিংদীর লটকন পাড়ি দেয় ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। নরসিংদীর লটকন খেতে সুস্বাদু হওয়ায় এখানকার লটকনের আদর-কদর বিশ্বব্যাপি বেড়েই যাচ্ছে। রপ্তানি হচ্ছে ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্ব বিভিন্ন দেশে আর এই জন্য অর্থনৈতিক গুরুত্বও বেড়েছে নরসিংদীর লটকনের। একসময়ের অপ্রচলিত বন্য ফল লটকন এখন দেশের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান বয়ে আনছে। কৃষকরা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ায় লটকন চাষের প্রতি আগ্রহ বাড়ছে। বিশ্ব বাজারে রপ্তানি হওয়ায় কৃষকরা লটকনের ন্যায্য দামও পাচ্ছেন।
জ্যৈষ্ঠ মাস (মে-এর মাঝামাঝি)থেকে শ্রাবণ মাস (আগস্টের মাঝামাঝি)পর্যন্ত লটকনের ভরা মৌসুম। তবে ভাদ্রের মাঝামাঝি (আগস্ট শেষ) পর্যন্ত কিছু লটকন পাওয়া যায়। গাছের গোঁড়া থেকে শুরু করে শাখা-প্রশাখা সর্বত্রই থোকায় থোকায় ঝুলে থাকে লটকন। এতটুকু ফাঁকা নেই গাছের কোথাও, দেখলে মনে হয় লটকনের ফুল ফুটেছে। বাগানে গাছের নিচে ঝরা শিউলী ফুলের মত পাকা লটকন ঝরে পড়ে মাটিতে বিছানা তৈরি করে; দেখলে প্রাণ জুরিয়ে যায়। শুধু দেখায় না খেতেও নরসিংদীর লটকন অদ্ভুত স্বাদের, মিষ্টি রসে মুখ ভরার সাথে সাথে মনটাও ভরে যায়। তাই আসুন নরসিংদীতে মন ভরে নিজ হাতে লটকন পেড়ে খেতে।
নরসিংদীর মৌসুমি ফল লটকনের কেনাবেচার সুবিধার্থে শিবপুরের কামারটেক বাজার, গাবতলী বাজার, চৈতন্য বাজার ও রায়পুরার মরজাল বাজার এই সবগুলো বাজারেই প্রতিদিন সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত লটকনের হাট বসে। চাষিরা খুব ভোরে লটকন তুলে ছোট ছোট ঝুড়িতে ভরে হাটে নিয়ে আসেন। বিভিন্ন জেলার পাইকারি ক্রেতারা এসব হাট বা বাজারে আসেন লটকন কিনতে। পাইকারা কখনও কখনও বাগান থেকেও লটকন কিনেন। এছাড়াও কৃষকরা ফলন্ত লটকন বাগান পাইকারি বিক্রি করে দেন। এভাবেই হাত বদল হতে হতে লটকন চলে যায় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এবং বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। এক কথায় বললে বলতে হয় লটকন এখন নরসিংদীর ঐতিহ্য।
ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নরসিংদীর লটকন রপ্তানি হচ্ছে। অপূর্ব স্বাদের জন্য মূলত দেশ-বিদেশ সর্বত্রই এখানকার লটকনের চাহিদা অনেক বেশি। পাইকাররা হাট কিংবা সরাসরি বাগান থেকে লটকন কিনে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করেন।বিশ্ববাসীরা বেড়াতে আসুন নরসিংদীতে খেয়ে যাবেন মন ভরে নিয়ে যাবেন ব্যাগ ভরে।
লটকনের পুষ্টিগুণের কথা আজ আর কারো অজানা নয়। এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও খাদ্য-শক্তি এছাড়াও আছে নানারকম খনিজ উপাদান। দিনে দুই থেকে তিনটি লটকন খেলে মানুষের এক দিনে ভিটামিন-সি এর চাহিদা পূরণ হয়।লটকন ফল খাদ্য-শক্তির ভালো উৎস। দৈনন্দিন কাজ করার জন্য দেহকে সক্রিয় রাখতে যে খাদ্য-শক্তির প্রয়োজন হয় তা পাওয়া যায় লটকন থেকে। লটকনের খাদ্য-শক্তি কাঁঠালের প্রায় দ্বিগুণ। এই ফলে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন-সি এছাড়াও আছে ভিটামিন-বি১ ও বি২, শর্করা, প্রোটিন, আয়রন, লোহা, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাশিয়াম, ক্রোমিয়াম ও চর্বি। লটকন গাছের ছাল ও বীচি থেকে রং তৈরি করা হয়, এই রং রেশম সুতা রং করতে ব্যবহার করা হয়।
কম খরচে কম পরিশ্রমে অধিক লাভজনক ফসলের মধ্যে অন্যতম ফসল হচ্ছে লটকন। লটকন ফলের চাষ করতে শুরুতে একটু খরচ পড়লেও বাগান পরিণত হওয়ার পর সামান্য খরচ ছাড়া আর তেমন কোন ঝামেলা পোহাতে হয় না। কম খরচ ও কম পরিশ্রমের তুলনায় লাভের পরিমাণ অনেকটা-ই বেশি। বাংলাদেশের দেশের অন্য জেলার বিভিন্ন উপজেলায় বাণিজ্যিকভাবে লটকন চাষ হলেও নরসিংদীর বেলাবো ও শিবপুর উপজেলায় ব্যাপকহারে বাণিজ্যিকভাবে লটকনের চাষ করা হয়, তাছাড়া নরসিংদীর লটকনের স্বাদে অন্য রকম বলে নরসিংদীর লটকনের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা অনেক বেশি। তাই বলছি আসুন নরসিংদীতে প্রাণ ভরে দেখতে মন ভরে খেতে নিজ হাতে পেড়ে ব্যাগ ভরে লটকন নিতে।
নরসিংদীর বেলাবো ও শিবপুরের উঁচু লাল মাটিতে ক্যালসিয়াম ও খনিজ উপাদান প্রচুর পরিমাণ থাকায় এখানকার মাটি ও আবহাওয়ায় লটকন চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এছাড়া লটকন চাষের উপযোগী মাটি আছে মনোহরদী ও রায়পুরার কিছু এলাকায়। নরসিংদীর রায়পুর, বেলাবো ও শিবপুর উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি লটকন উৎপন্ন হয় শিবপুর উপজেলাতেই, শিবপুরের লটকন খেতেও সবচাইতে সুস্বাদু। এখানকার লালখারটেক, সৃষ্টিগড়, শৈকারচর, চৈতন্য, শ্রীরামপুর, ভঙ্গারটেক, যোশর, আগরপুর, আমরাতলী, টঙ্গিরটেক, মাকাল্লা, ভিটিখৈনকুট, দেবালেরটেক, জাঙ্খারটেক দক্ষিণ কামালপুর, কামারটেক, চান্দারটেক, শরীফপুর, মুরগীবের, কুলুরটেক, কাজিয়ারা, পুরানা আটশিয়া, নৌকাঘাটা, নন্দিরটেক, লেটাব, পাহাড়ফুলদী, মাছিমনগর, মালিয়ারাসহ আশপাশের সব গ্রামেই আছে লটকনের বাগান।
সাধারণত বর্ষা মৌসুমে চারা লাগানোটাই ভাল তবে সারা বছরই লটকনের চারা লাগানো যায়। নরসিংদীর মানুষের আলাদা করে বীজ লাগিয়ে চারা তৈরি করতে হয় না, পাখি খেয়ে লটকন ফেলে দেয় আবার গাছ থেকেও লটকন মাটিতে পড়ে থাকে সেই লটকন থেকেই চারা গজায় এবং ঐ চারা লাগিয়ে বাগান তৈরি করা হয়। চারা লাগানোর প্রায় চার বছর পর থেকে গাছে ফল ধরতে শুরু করে। নরসিংদীতে লটকনের চারাও বিক্রি করা হয়। গাছের ফল পারা শেষ হলে গাছের গোঁড়ায় কিছু মাটি ও গোবর দিতে হয়। সাধারণত লটকন গাছে এর চেয়ে বেশি যত্ন করতে হয় না। লটকন গাছের কাঠ শুধুমাত্র জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয় কোন কাজে লাগে না।
একটি লটকন গাছ মানেই মূল্যবান সম্পদ। তাই নরসিংদীতে বাগান ছাড়াও প্রায় প্রতিটি বাড়ির আঙ্গিনায় ও আশপাশে রয়েছে লটকনের গাছ। লটকন ফল নরসিংদীর মানুষের অন্যতম অর্থকরী ফসলে পরিণত হওয়ায় আর্থিকভাবে সমৃদ্ধ হয়েছে এখানকার মানুষের জীবন। তাই বলছি লটকন নরসিংদীর ঐতিহ্য। সব শেষে আবারও বলছি আসুন নরসিংদীতে প্রাণ ভরে দেখে যান মন ভরে খেয়ে যান ব্যাগ ভরে নিয়ে যান নরসিংদীর লটকন!
প্রতি ১০০ গ্রাম লটকনের কোয়ায় ( Burmese grape ) পুষ্টিগত মান
| |
খাদ্যগুণ
|
92 kcal
|
প্রোটিন
|
1.42 g
|
ভিটামিন-বি১
|
10.04 mg
|
ভিটামিন বি২
|
0.20mg
|
ভিটামিন সি
|
178 mg
|
ফ্যাট
|
0.45 g
|
ক্যালসিয়াম
|
9 g
|
পটাশিয়াম
|
177 mg
|
শর্করা
|
137 mg
|
লোহা
|
100 mg
|
জলীয় অংশ
|
35.6 g
|
আয়রন
|
5.34 mg
|
এছাড়াও লটকনে আছে কার্বোহাইড্রেট, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস সোডিয়াম, ক্রোমিয়াম
|
(ছকটি সংগৃহীত)
No comments:
Post a Comment