google-site-verification: google3e58058dabcd012d.html পয়ন্তপ : বাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কাঁধে কবি নজরুলের লাশ

বাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কাঁধে কবি নজরুলের লাশ


বাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কাঁধে কবি নজরুলের লাশবাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কাঁধে কবি নজরুলের লাশ

বাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কাঁধে কবি নজরুলের লাশ





বাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কাঁধে কবি নজরুলের লাশ
১৯৭৬ সালে কবি নজরুল ইসলামের মৃত্যু সংবাদ প্রচারিত হলে আন্তরিক দুঃখ ও শোক অনুভব করি। কবি নজরুল দীর্ঘদিন দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেন। অত্যন্ত অযত্ন অবহেলা ও প্রায় বিনা চিকিৎসায় ২৬/২৭ বছর কলকাতায় থাকার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন এবং জাতীয় কবি ঘোষণা করেন। বাংলাদেশে কবির উন্নত বাসস্থান, খাদ্য, বস্ত্র, ও চিকিৎসার ব্যবস্থা হয়েছিল। দেশবাসীর অপরিমিত সম্মান প্রাপ্ত হয়েছিলেন কাজী নজরুল। তাঁর বাংলাদেশ অবস্থানকালে ঢাকার সবচেয়ে দর্শনীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আগত শিক্ষিত রুচিবান সাহিত্য সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ ঢাকার চিড়িয়াখানা যাদুঘর দেখার চেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছেন কাজী নজরুলকে দেখার, তাঁকে একটু ছুঁয়ে দেখার। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের মানুষও সুযোগ
পেলেই কবি নজরুলকে দেখতে ধানমন্ডি চলে যেতেন। একারণে তাঁর জন্য বরাদ্দ ছোট লম্বাটে বাড়িটাতে সর্বদা ভিড় লেগেই থাকতো।


আমরা তখন নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ খন্দকার পাড়ায় থাকি। কলেজের লেখাপড়া ইস্তফা দিয়ে বাড়ীতে বেকার বসে আছি। কম লেখাপড়ায় কোন কাজেরও সুযোগ পাচ্ছিনা। চরম আর্থিক সংকটে দিনাতিপাত করছি। বেকার ছেলেদের আত্মসম্মানজ্ঞান টনটনে হয়। আমারও তাই ছিল। এমতাবস্থায় পূর্বে কেনা মূল্যবান বই ১নং ডিআইটি মার্কেটের এক কোনে ফুটপাতে বসা পুরোনো বইয়ের এক দোকানে গায়ের মূল্যের এক তৃতীয়াংশ দামে বিক্রি করে হাত খরচের টাকা জোগাড় করি। প্রিয় বই হাতছাড়া করতে খুব কষ্ট লাগে, তারপরও হাত খরচ ও সিগারেটের প্রয়োজনে বাধ্য হতাম।


কবি কাজী নজরুলের মৃত্যু সংবাদ যখন পাই তখন আমার হাতে একটি টাকাও নেই। অথচ ঢাকা যেতে আসতে ভাড়া তিনটাকা, চা সিগারেট ১ টাকা অন্তত: চার টাকা প্রয়োজন। টাকা নেই তবু তাঁর মৃত মুখটা অন্তত: শেষবারের মতো দেখার প্রবল ইচ্ছা। অগত্যা কয়েকটি ভালমানের প্রায়নতুন বই নিয়ে হাটতে হাটতে দেড় মাইল দূরের ডিআইটি মার্কেটে ছুটলাম। তখন বেলা ১১টার মতো হবে। ভাবছি যদি এই সময় দোকানটি খোলা না থাকে তবে ঢাকা যাওয়া তো হবেই না উল্টো ফের দেড় মাইল পথ হেটে বাসায় ফিরতে হবে। ভাগ্য ভাল ফুটপাতের পুরনো বইয়ের দোকানটি খোলা পেয়েছিলাম। পাঁচটি বই সাকুল্যে সাত টাকায় বিক্রি করে ২ নং রেল গেট থেকে বাসে যানজটবিহীন রাস্তায় আধা ঘণ্টার মধ্যে গুলিস্তান পৌঁছে গেলাম। জোড় কদমে হাটতে হাটতে টিএসসি।


কবি নজরুলের লাশ জনসাধারণের শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য টিএসসির গেটের বাইরের অর্ধ গোলাকার চত্বরটিতে রাখা ছিল। লাইন দিয়ে কবির নিথর মুখ চোখ দেখলাম। কামানো মুখে এক দেড় মিলিমিটার পরিমাণ দাঁড়ি গোফ গজিয়েছে। এত বড় ঢাকা শহর, তখনও সেখানে অন্তত: পঞ্চাশ লাখ জনসংখ্যা অথচ কবি নজরুলকে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য আগত মানুষের সংখ্যা খুবই কম। শ্রদ্ধা জানিয়ে অনেকেই চলে গেছেন অবশ্য, তবে শেষ পর্যন্ত খাটের চারপাশে মাত্র দুই তিন শত ভক্ত অনুরাগী দাঁড়িয়ে-বসে ছিলেন। ইদানিং তাঁর চেয়ে অনেক অনেক ছোট মাপের মহাপুরুষদের শবাধারেও হাজার হাজার মানুষের ভিড় লক্ষ্য করা যায়। রেডিও, টিভি লাইভ প্রচার করে। অথচ তখনও মানুষ ছিল, টিভি ছিল তখনও।


কবি নজরুলের লাশ কোন কফিনে নয়, মসজিদের খাটে করে টিএসসিতে নিয়ে আসা হয়েছিল। জানাজা সম্ভবত: বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদেই হয়েছিল কিংবা টিএসসি লাগোয়া সরোয়ার্দী উদ্যানেও হতে পারে মনে করতে পারছিনা। জানাজার পূর্বে সম্ভবত প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমানও এসেছিলেন এবং জানাজায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। জোহর নামাজের পর জানাজা হয়েছিল। জানাজার সময় জানা থাকায় এবং রেডিও টিভিতে সব অনুষ্ঠান বাদদিয়ে অবিরত নজরুলের ইসলামী সঙ্গীতগুলো বাজতে থাকায় জানাজায় কয়েক হাজার মুসল্লি অংশ গ্রহণ করেছিলেন।


টিএসসি থেকে জানাজার উদ্দেশ্যে কবির লাশবাহী খাট নিয়ে আসার সময় ঘটে আমার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি। বারবার ঘুরে ঘুরে কবির মৃত মুখ দেখছি, কখনো দাঁড়িয়ে থাকছি খাটের কাছেই। এমন সময় কে যেন সম্ভবত: অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অথবা শিল্পী খালিদ হোসেন হবেন। কেননা তাঁরাই তখন কবির লাশ, দর্শনার্থী তদারক করছিলেন, বললেন, এই খাট তোল। কয়েকজন এগিয়ে এসে খাট ধরলো। আমিও কাছে থাকায় সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যাই। আমিও খাট তুলি এবং কাঁধে নেয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি। দুই-তিন মিনিটের মধ্যে অনেকেই এসে খাট ধরার জন্য হুরোহুরি শুরু করলে এক পর্যায়ে আমি ছিটকে যাই।


সাধারণত: কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বের ইন্তেকালের পর কোন আত্মীয় গোসল করাবে, কোন কোন পুত্র-পৌত্র লাশ কাঁধে নিবে, কারা কবরে নামবে তা পূর্ব নির্ধারিত থাকে বা ঘনিষ্ঠদের অগ্রাধিকার থাকে। ফলে অপরিচিত অনাত্মীয় কারো পক্ষেই সম্ভব হয়না এসব ক্রিয়াকর্মে হস্তক্ষেপ করার। আগ বাড়িয়ে কেউ আগ্রহ দেখালে অন্যেরা বিরক্ত হন। কিন্তু কবি নজরুলের বেলায় হয়েছে এর উল্টো। তাঁর দাফন কাফন জানানা সবই হয়েছে অনাত্মীয় অনুরাগীদের হাতে।





সবাই জানেন কবি কাজী নজরুলের জীবনটাই কেটেছে ছন্নছাড়া অবস্থায়। শিশুকাল থেকে মৃত্যু অবধি কবি নজরুলের তেমন কোন অভিভাবক ছিলনা। পরিবারের লোকজনও ছিলনা তাঁর মৃত্যু শয্যায়। ঢাকা মেডিকেলের এক কেবিনে ডাক্তার নার্সদের মধ্যে থেকে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।


‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিও ভাই ............’ এর অমর স্রষ্টা কবি নজরুলকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মসজিদের পাশেই কবর দেয়া হলো। অত্যন্ত বিস্ময় ও দুঃখের সঙ্গে মনে পড়ে এত বড় কবি, বিশ্ব মাতানো কবি, উভয় বাংলার ঘরে ঘরে উচ্চারিত নাম সুপরিচিত কবি, গানের রাজা, সুরের যাদুকর, ১৪টি রাগের শ্রষ্ঠা কবিকে দাফনে অংশ নিয়েছিলেন, আমি যদি ভুল না করি, মাত্র হাজার খানেক মানুষ। বাংলাদেশের মানুষ বুঝলোনা কি হারালো তারা। নিজ জীবন, পুত্র পৌত্রাদির জীবন তথা একটি জাতির জীবনে যাঁকে কখনোই ভুলে থাকা সম্ভব হবেনা তাঁকে উপযুক্ত বিদায় সংবর্ধনা দিতে পারলাম না আমরা। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের কবরে ফুল বা ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো প্রচলিত রীতি। দলে দলে রাজনৈতিক সামাজিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এসে তাদের নাম শোভিত ফুলের ডালা কবরে স্থাপন করেন। কবি নজরুল তা থেকেও বঞ্চিত হয়েছিলেন। শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চারুকলা কলেজ ও উদীচীর পক্ষ থেকে ফুলের ডালা দেয়া হয়েছিল। কোন রাজনৈতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে নয়। অবশ্য তখন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু সংগঠন ও নেতৃবৃন্দতো ছিলেন।


কবি নজরুলকে মাটি দিয়ে লোকজন প্রায় সবাই চলে গেছে, মাঝে মাঝে একজন দুজন করে এসে পাশ থেকে মাটি নিয়ে কবরে তুলে দিয়ে দাফনে শরিক হচ্ছেন। ২০/৩০ জনের মতো কবরের এদিক সেদিক দাঁড়িয়ে-বসে আছেন। আমি কয়েক জনের সঙ্গে কবরের পশ্চিম পাশের অনতিউচ্চ দেয়ালে উদাস মনে বসে আছি। কি যেন কোন গভীর শোক কবরস্থান থেকে নড়তে দিচ্ছেনা। এমন সময় কবরের সামনে এসে হাজির হলেন কবিপুত্র কাজী সব্যসাচি, কাজী অনুরুদ্ধের স্ত্রী কল্যাণী কাজী, একটি বাচ্চা ছেলে এবং দুজন বয়স্ক ব্যক্তি। তাঁরা কলকাতা থেকে এসেছেন। বিমান বিলম্বিত হওয়ায় কবিপুত্র জানাজা ও দাফনে অংশ নিতে পারেন নি। তাঁদের জন্য দাফন কাফন বিলম্বিতও করা হয়নি। কবির একমাত্র জীবিত সন্তানের সম্মতি ব্যতীত, উপস্থিতি ব্যতীত, এত বড় মাপের একজন জাতীয় ব্যক্তিত্বের দাফন সঙ্গত হয়নি। কর্তৃপক্ষের উচিৎ ছিল অবশ্যই কাজী সব্যসাচী ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জন্য অপেক্ষা করা।





বিটিভির কল্যাণে কাজী সব্যসাচীসহ নজরুলের পরিবারের সবাই দেশবাসীর পরিচিত। বঙ্গবন্ধু কবি নজরুলকে বাংলাদেশে নিয়ে আসার পর কবি পরিবারের সকল সদস্য একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন, থেকেছেন, টিভিতে সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। বিশেষ করে কাজী সব্যসাচী ছিলেন প্রখ্যাত আবৃত্তি শিল্পী। তাঁর ভরাট কণ্ঠে বিদ্রোহী কবিতার আবৃত্তি যারা শুনেছেন দীর্ঘদিন মনে থাকবে তাদের। যতদূর মনে পড়ে নজরুলের ইন্তেকালের সময় তাঁর পুত্রবধূ উমা কাজী, নাতনী মিষ্টি কাজী, খিলখিল কাজী ও নাতি বাবুল কাজী সবাই ঢাকায়ই ছিলেন। কিন্তু সমাধিস্থানে তাদের দেখিনি। কাজী সব্যসাচীর স্ত্রী উমা কাজী ছিলেন কবি কাজী নজরুলের সর্বক্ষণের সঙ্গী ও শুশ্রূষাকারী। যদিও তিনি তখন বিক্রমপুরের এক ভদ্রলোককে বিয়ে করে দূরে চলে গিয়েছিলেন।


কবির কবরের পাশে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাজী সব্যসাচী। যেন কিছুই বলার নেই। করার নেই কিছুই। চেহারায় একই সঙ্গে শোক, বেদনা, অসহায়ত্ব খেলা করছিল তাঁর। আর কল্যাণী কাজী হুঁ হুঁ করে কাঁদছিলেন আর বলছিলেন, বাবার সঙ্গে শেষ দেখা হলোনা। তাঁর কান্না জড়িত কথাগুলো এখনো মনে আছে। সেখানে যারা উপস্থিত ছিলেন তারা, বিশেষ করে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম অবশ্যই এই কথার সত্যতা নিশ্চিত করবেন। তিনি শেষ পর্যন্ত সেখানে ছিলেন। কল্যাণী কাজী কেঁদে কেঁদে এতটুকু কথাই কয়েকবার বলেছিলেন। আর কোন কথা বলেননি। ৫/৭ মিনিট পরেই কবরস্থান ত্যাগ করেছিলেন তাঁরা।


দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কাজী সব্যসাচী পিতার জন্য আল্লাহর দরবারে মাগফেরাত কামনা করেছিলেন কিনা জানিনা। করেছেন তো অবশ্যই। তবে যা জানি এবং নিজ চোখে দেখেছি, কবি কাজী নজরুলের অত্যন্ত আদরের এই পুত্র কিন্তু পিতার কবরে মাটি দেয়ার শেষ সুযোগটুকুও গ্রহণ করেননি। এমন বিশ্ববিখ্যাত, সর্বোচ্চ সম্মানিত সর্বজনপ্রিয়, অজাতশত্রু, একটি দেশের জাতীয় কবি পিতার অন্তিম শয্যায় পাশে থাকতে না পারার বেদনা, জানাজা না পাওয়ার দুর্ভাগ্য, শেষ দেখা দেখতে না পাওয়ার কষ্ট, কবরস্ত করতে না পারার শোকে যেখানে কবর পার্শ্বে গড়াগড়ি দিয়ে বিলাপ করার কথা, সেখানে সদ্য খোড়া কবরে মাটিটুকু পর্যন্ত তুলে দিয়ে দাফনে শরিক হয়না স্বয়ং সন্তান, এমন কখনও দেখিনি।

No comments:

এইটুকুতেই আমাদের হয়ে যাবে, আর লাগবে না

এইটুকুতেই আমাদের হয়ে যাবে, আর লাগবে না বিবেক সম্পন্ন মানুষ হওয়ার প্রয়োজনে শিক্ষা গ্রহণের জন্য মোটা মোটা পুস্তক আর বড় বড় অট্টালিক...