![]() |
কবি শামসুর রাহমান |
বাবুল মোশাররফের স্মৃতিচারণ, কবি শামসুর রাহমানের সোনারগাঁও ভ্রমণ
![]() |
বাবুল মোশাররফ |
আর যাদের কোন আত্মীয় পরিচিত ছিলনা তারা সঙ্গে করে খাবার নিয়ে আসতেন অথবা পিকনিক করে খেতেন।
একদিন আমার সহকর্মী বন্ধু কবি সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল বললো, রাহমান ভাইকে নিয়ে আমরা কয়েকজন সোনারগাঁওয়ে যাব। উনি আপনার বাড়ীতেও যেতে চান। আমি দুলালকে ধমক দিয়ে বললাম, উনি কি আমাকে চিনেন, না দহরম মহরম আছে যে আমাদের বাড়ীতে যেতে চাইবেন। সে বলল, সোনারগাঁওয়ে যাওয়ার প্রস্তাব উঠলে আমি বলেছিলাম সেখানে বাবুল মোশাররফের বাড়ী আছে, যাদুঘরের কাছেই। তখন রাহমান ভাই বললেন, তাহলে তো ওদের বাড়ীতে যাওয়াই যায়। তবে কিছু খাব না কিন্তু। আমরা তো প্যাকেট খাবার নিয়েই যাব। যাদুঘরে বসে খাওয়া সারবো। দুলাল আরও বললো, রাহমান ভাই আপনাকে খুব ভাল করে চিনেন এবং আপনার প্রসঙ্গে স্নেহমিশ্রিত কথা বলেন। বুঝলাম দুলাল আমাকে তেল মারছে। হেসে বললাম, মিথ্যা বলার আর জায়গা পান না। জীবনে উনার সঙ্গে আমার কথাই হয়নি। আর আমার মতো চেংড়া ছেলেকে স্নেহ করবেন কেন? সে বলল রাহমান ভাই কথা প্রসঙ্গে অনেকের সামনে বলেছেন, আমি আর কবিতা লিখতে পারছি না। এ কথাটা একটা ছেলেই সাহস করে বলেছে। আমার কবি বন্ধু বান্ধব কেউ এমন কথা বলে সতর্ক করেনি।
এবার বিশ্বাস হলো এবং লজ্জাও পেলাম। কয়েক মাস পূর্বে শামসুর রাহমানের একটি কাব্য গ্রন্থের আলোচনায় আমি এমন বেয়াদবী কথা লিখেছিলাম। গ্রন্থটির নাম সম্ভবত ‘অবিরল জলভূমি’ কিংবা ‘ধূলায় গড়ায় শিরস্ত্রাণ’ ও হতে পারে। কবি শামসুর রাহমান আমাদের বাড়ী আসবেন এটা আমার জন্য অত্যন্ত গৌরবের কথা। আমি, আমার পরিবার ধন্য হয়ে যাব। উজ্জ্বল হবে আমাদের গ্রামের নাম।
সোনারগাঁওয়ে এলে আমাদের বাড়ী আসার রাহমান ভাইয়ের ব্যক্তিগত আগ্রহের কথা শুনে দুলালকে বললাম, প্যাকেট নেবার দরকার নেই, আপনারা আমাদের বাড়ীতেই ডালভাত খাবেন। কিন্তু দুলাল রাহমান ভাইয়ের বরাতে তা অস্বীকার করলো। না, তাহলে তিনি রাগ করবেন। দুলাল বলেছিল তাঁরা ১১/১২ জন কবি সাহিত্যিক রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে থাকবে। পরে দেখা গেছে তাঁরা ২০/২৫ জন এসেছেন ২/৩ টি মাইক্রো করে।
তাঁরা যখন দুপুরে খাবেন না তখন কি খাওয়ানো যায় ভাবছি। এমন অতিথিদের তো আর চা বিস্কুট খাওয়ানো যায় না, সেমাই পায়েসও অনেকটা পানসে। মা-বোনদের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলাম তাঁদের পিঠা খাওয়াবো। এতে কিছু খাওয়ানোও হবে আবার গ্রামীণ ঐতিহ্যও রক্ষা হবে। ওদের আগমনের দিনের পূর্বরাত্রে মা বোনেরা রাত্র ভর পুলি পিঠা তৈরী করতে বসলেন। সকাল থেকে পাটি সাপটা পিঠা।
সকাল ১০টার দিকে তাঁরা এলেন। পানাম এসে আমাদের গ্রাম এবং আমাকে খুঁজতে লাগলেন। গ্রাম সহজে পেলেন কিন্তু আমাকে কেউ চিনতে পারছেনা। যদিও আমি সঠিক ভাবে ঠিকানা দিয়েছিলাম কিন্তু মধ্য পানাম এসে এঁরা হোঁচট খেলেন। এলাকার যাকেই জিজ্ঞেস করেন এই গ্রামে বাবুল মোশাররফ নামে কোন কবিকে চিনতে পারছেনা! উল্লেখ্য, মাত্র বছর খানেক হয় আমরা স্বপরিবারে নারায়ণগঞ্জ থেকে ২০ বছর পরে বাড়ী এসেছি। এলাকার লোকজনের সঙ্গে তেমন জানাশোনা হয়ে উঠেনি। আর পানাম তো ভিন্ন গ্রাম। তাছাড়া তখন দোকানপাটও তেমন ছিলনা আদমপুরে কয়েকটি ছাড়া। মুন্সীরাইল বাজার ছিল জমজমাট তবে ওখানে আমার যাতায়াত তেমন ছিলনা। ওদেরও ততদুর যেতে বলিনি। শামসুর রাহমান ভাইকে গাড়ীতে রেখে ঢাকার তরুণ কবি-সাহিত্যিকরা একদল গেলেন পানাম দেখতে, একদল মুন্সিরাইল বাজারের দিকে এবং একদল বাগমুছার দিকে আমার সন্ধানে বেড়িয়ে গেছে। তখন মোবাইল ছিলনা বিধায় সমস্যাটা হয়েছে। অবশেষে বাবুরবাগ এসে একজনকে বলতেই সে আমাদের বাড়ীর লোকেশন দেখিয়ে দিল সঙ্গে সেও আসলো এবং তাঁরা এসে পড়েছেন জেনে দৌড়ে পানাম গেলাম এবং রাহমান ভাইকে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, রাহমান ভাই আমি’ই বাবুল মোশাররফ, সেটাই রাহমান ভাইয়ের সাথে আমার প্রথম আলাপ। এর মধ্যে দেখি যারা মুন্সীরাইল বাজারের দিকে গিয়েছিল, তারা আমার চাচাত ভাই আলাউদ্দিনকে সঙ্গে করে নিয়ে আসছে। আলাউদ্দিন এদের চেহারা সুরৎ ভাব ভঙ্গি দেখে ও কবি শামসুর রাহমানের কথা শুনে দোকান ফেলেই চলে এসেছে বাড়ীতে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
অতঃপর সবাইকে নিয়ে বাড়ী আসলাম। যে বড় ঘরটায় আমার নানী থাকতেন আমিও থাকতাম সেখানে তাদের বসালাম। রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে যে সব কবি সাহিত্যিকরা এসেছিলেন তাদের সবাইকে আমি চিনি না। আর যাদের চিনেছি তাদের অনেকের নামও এখন মনে করতে পারছিনা। তবে সাইফুল্লাহ মাহমুদ দুলাল ছাড়াও ফরিদ কবির, রবিন্দ্র গোপ, নাসরিন জাহান, আশরাফ মাহমুদ এদের কথা মনে আছে। কবি শামসুর রাহমান আসবেন বলে সাংবাদিক মাহফুজুর রহমান ও সালেহ জুম্মান কে থাকতে বলেছিলাম। কারণ তখন তারা দুজনেই ছিলেন আমার বন্ধু। সালেহ জুম্মান ছিল কিনা মনে নেই তবে কবিরা আসার সঙ্গে সঙ্গে মাহফুজ ভাই এসেছিলেন এবং তাদের আপ্যায়ন থেকে শুরু করে কথা বার্তায় গাইডেন্সে আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। তিনি তখন দৈনিক বাংলার বানীতে কাজ করতেন। পিঠা রাতেই তৈরী করা ছিল। আন্দেশা পিঠা ঠাণ্ডা হলেই মজা হয়। প্রথমেই আমাদের টিউবওয়েলের বিখ্যাত মিষ্টি পানি এবং আন্দেশা পিঠা দিলাম। পরে গরম গরম পাটি শাপটা পিঠা। পিঠা ছিল পর্যাপ্ত। নানীর স্টকে থাকা কিছু ফুল পিঠাও পরিবেশন করা হয়েছিল। ধারণার চেয়ে বেশী মেহমান আসায় সকল পিঠাই তাঁদের জন্য ব্যয় হয়েছিল। আমরা আর পরে তেমন খেতে পারিনি। মাহফুজ ভাইও সম্ভবত পিঠার ভাগ পাননি।
আমার সঙ্গে আলাপচারিতায় রাহমান ভাই জানতে চেয়েছিলেন এখানকার এম.পি কে ? বললাম মোবারক হোসেন। বললেন কোন দলের। বললাম আওয়ামীলীগের। একথা শুনে তিনি খুব খুশী হয়েছিলেন।
ঘণ্টা দুই আমাদের বাড়ীতে অবস্থান করে তারা বললেন প্রাকৃতিক পরিবেশে কোথাও বসতে পারলে ভালো হতো। রাহমান ভাই বললেন এই বাড়ীটার পরিবেশ যথেষ্ট সুন্দর। এখানেই গাছ তলায় মাদুর বিছিয়ে বস। আমাদের বাড়ীটা তখন গাছ গাছড়ায় ভরপুর ছায়া সুনিবিড় ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ছিল, কে একজন বললো এখানে তো অনেকক্ষণ থাকলামই একটা ভিন্ন পরিবেশ হলে ভাল হতো না? এতে সবাই সায় দেওয়ায় আমাকেই চিন্তা করতে হলো কোথায় গেলে এমন প্রকৃতিপ্রেমী কবি সাহিত্যিকদের মনটা উল্লাসিত হবে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে মুন্সিরাইল বাজারের রহিপুরা পুকুরের ঘাটে পশ্চিম পাশে প্রশস্ত পাড়ে, চতুঃপার্শ্বে গাছগাছালিতে ভরপুর প্রাকৃতিক পরিবেশে নিয়ে গেলাম। ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ের মতো রহিপুরা পুকুরের পরিপাটি শোভা দেখে উপস্থিত সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। কেউ কেউ এমনও বললেন, যদি সম্ভব হতো তাহলে সাড়া জীবন এখানেই থেকে যেতাম।
রহিপুরার বিশাল শান বাধানো ঘাটে সবাই একটু বসলেন। শীতের স্নিগ্ধ রোদ তেতে উঠায় আর দু’একজন করে গোছল করতে আসায় আমরা ঘাটের কাছেই লিচু তলায় ঘাসে মাটিতে বসে পড়লাম। কাপড় চোপড় ময়লা হলো কি হলোনা সেদিকে কারো ভ্রুক্ষেপই ছিলনা।
রহিপুরা পুকুরপাড় সবার উপস্থিতিতে শুরু হলো মজার খেলা র্যাফেল ড্র। ফরিদ কবিরের উপস্থাপনায় একটি কাগজে আগে থেকেই তৈরী করে রাখা নানা সাবজেক্ট পরিবেশনে হাসি ঠাট্টার খেলা। কারো ভাগ্যে গান গাওয়া উঠছে তো সে বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো, কারো ভাগ্যে নাচ পরেছে তো ছেলে হোক মেয়ে হোক একপ্রস্ত নেচে হাসালো। কারো ভাগ্যে কবিতা আবৃত্তি, কারো অভিনয়। সবাইকে কঠোরভাবে বলা আছে কেউ ভাগ্যকে অস্বীকার করতে পারবেনা। যার কপালে যা উঠবে তা মেনে নিতে হবে। লজ্জা করাও যাবেনা। প্রধান এবং এক মাত্র বিচারক হিসেবে মধ্যমণি হয়ে বসেছেন কবি শামসুর রাহমান। এক সময় আমার পালা এলো। ড্রতে উঠলো মহিলা যাত্রা শিল্পীর অভিনয়। হঠাৎ করে চমকে গেলেও আমিও যোগ্যতার সাথেই মিনিট খানেক অভিনয় করে দেখালাম। বানানো সংলাপে আমি ‘নাথ’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলাম। যেমন- আমাকে পরিত্যাগ করোনা নাথ! ........এরকম। সবাই মুহুর্মুহু করতালিতে অভিনন্দন জানালো। সকলকে যেমন জানায়। রাহমান ভাই বললেন, হঠাৎ অভিনয়ে তুমি ‘নাথ’ শব্দটি আনলে কি ভাবে? খুব ভাল। কে একজন ফোড়ন কাটলো, প্রতিভা আছে! আমি কাচু মাচু প্রায়।
অত:পর বেলা খানিকটা সময় ব্যয় করে ঘাটে কেউ কেউ হাত মুখ ধুয়ে যাদুঘরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। গাড়ি গুলোকে যাদুঘরে পার্ক করতে পাঠিয়ে দেয়া হলো। সবাই হেটে হেটে পানাম অতিক্রম কালে দেখা হলো কবি বেলাল চৌধুরীর সঙ্গে। তিনিও এসেছেন আলাদা ভাবে। বেলাল চৌধুরী আর না ঘুরে রাহমান ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলতে বলতে যাদুঘরেই চলে গেলেন। যাদুঘরের দর্শনার্থীরা বেশীরভাগ শিক্ষিত সচেতন আগমন ঢাকা থেকে। যাদুঘরে গিয়ে মনে হলো সকল পর্যটক কবি শামসুর রাহমানকে চিনেন। যাদের হাতে ক্যামেরা আছে তারা ফটো তুলছেন। যাদের নেই তারা সেকহেন্ড করছেন। ইতোমধ্যে যাদুঘরের উপপরিচালক সৈয়দ মাহবুবুল আলম খবর পেয়ে চলে এসেছেন। তিনি সদলবলে কবিকে নিয়ে তার অফিসে চলে গেলেন। আর আমিও কাউকে কিছু না বলে বাড়ী চলে এলাম। পরদিন অফিসে গিয়ে শুনি ওদের সঙ্গে লাঞ্চে অংশগ্রহণ করিনি বলে রাহমান ভাই দুলালদের উপর খুব রাগ করেছেন।
আমি সদ্য বিয়ে করেছি, মাস দুই হবে। এ সময় নতুন জামাই নিয়ে শশুর বাড়িতে অনেক কৌতূহল থাকে। তার প্রকৃত যোগ্যতা অযোগ্যতা ভাল মন্দ নিয়ে মাথা ঘামাতে ভালোবাসে। আমার তেমন যোগ্যতা নেই। তৃতীয় শ্রেণির সরকারি কর্মচারী এটা সবাই জানে। সোনারগাঁওয়ের প্রখ্যাত সাংবাদিক মাহফুজুর রহমানের মধ্যস্থতায় আমার বিয়ে হয়েছিল। কবি শামসুর রাহমান আমাদের বাড়ী আসায় তিনি একটি মওকা পেয়েছিলেন আমার যোগ্যতা প্রমাণের। অনেক গর্বের সঙ্গে তিনি বিষয়টি শ্বশুর পরিবারের বিভিন্নজনের কাছে বিভিন্ন সময়ে বর্ণনা করে আমার সম্মান বৃদ্ধি করেছিলেন। এজন্য মাহফুজ ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে আছি। শ্বশুর পক্ষ কবি শামসুর রাহমানের উচ্চতা অনুভব করতে না পারলেও অন্তত: এতটুকু বুঝেছিলেন যে, ছেলেটি দরিদ্র হলেও সম্মান নিয়ে আছে। কবি শামসুর রাহমান দয়া করে আমাদের বাড়ীতে আসায় আমার এই উপকারটুকু হয়েছিল।
No comments:
Post a Comment