আজ সূর্য উদিত হোক- সেই বিজয় নিয়ে
পৃথিবীর সৃষ্টির পর থেকেই দিনের পর রাত, রাতের পর দিন এই নিয়ম চলছে, চলবে। নদীর স্রোতের মত বয়ে যাওয়া দিনগুলো থেকে ৭টি দিনকে নির্ধারণ করা হলো, আবার এই ৭দিনকে একত্রে নামকরণ করা হলো সপ্তাহ। এমনিভাবে হলো পক্ষ, মাস, বছর, যুগ, শতাব্দী।ঘুরে ফিরে যেমনি আসছে দিন, সপ্তাহ, পক্ষ, মাস, বছর, যুগ শতাব্দী তেমনি আসছে একেকটা দিনের, একেকটা মাসের, বছরের, যুগের শতাব্দীর ইতিহাস। ইতিহাস তো ঘটে যাওয়া ঘটনা মাত্র। হতে পারে সুখ কিংবা দুঃখ, হাসি কিংবা কান্না।এতে লুকিয়ে থাকে আনন্দ,
সুখ, হাসি, দুঃখ, বেদনা, কান্না, এক বুক জ্বালা-যন্ত্রণা। প্রকৃতির নিয়ম মত ঋতুচক্রের পথ ধরে ইতিহাসের পাতা উল্টাতেই থাকে। এর মধ্যে ব্যক্তি কিংবা জাতির কোন না কোন ঘটনা সামনে এসে দাঁড়িয়ে মনে করিয়ে দেয়, আবার পাতা উল্টে গেলে ভুলেও যায়। এমনই একটা ঘটনা- আজ ১৬ই ডিসেম্বর, বাংলাদেশের বিজয় দিবস। এই দিনে এদেশের মানুষ স্বাধীন দেশের বিজয়ের পতাকা উড়াবে, আনন্দ-উৎসব করবে, ঘটা করে দেশের জন্য দেশাত্মবোধক গান দিয়ে নাচে-গানে মাতিয়ে তুলবে, পত্র-পত্রিকায় বিশিষ্ট ব্যক্তিদের দেশপ্রেমের মহান বাণী ঢালাওভাবে প্রকাশ হবে, কত ধরণের মহান বক্তৃতা দেয়ার জন্য সভা-সমাবেশ হবে। এই দিন উদযাপনের ঘনঘটা দেখলে মনে হয় ‘বাংলাদেশের দেশপ্রেমিকের মত এমন দেশপ্রেমিকের কোথাও খুঁজে পাবে নাকো আর, সকল দেশের সেরা আমাদের দেশের মান’। একথাটুকু লিখতে গিয়ে দুঃখ না সুখ কোন অনুভূতিটা অনুভব করছি তা বলতে পারবো না, তবে এটা বলতে পারবো দেশটা একটা অগ্নিকুণ্ড। এখানে কেউ পুড়ে, কেউ পোড়ায়। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা ক্রমাগত বেড়েই চলছে, বেড়ে চলছে বিদ্বেষপরায়নতা, বেড়ে চলেছে স্বার্থপরতা, বেড়ে চলেছে দে-দে, মার-মার, ধর-ধর, খাই-খাই। আজকে এই বিজয়ের দিনেও এর ব্যতিক্রম হবে না। আমি জোর গলায় বলব এর ব্যতিক্রম হবে না। একটি উদাহরণ দিলেই হয়ত স্পষ্ট হবে, যুদ্ধের মাধ্যমে আমাদের দেশ স্বাধীন করা হয়েছে। সেই যুদ্ধের ৪৮তম বিজয় দিবস আজ। কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন করার জন্য যে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল সে যুদ্ধে কে কোন দয়িত্বে নিয়োজিত থেকে কর্তব্য পালন করেছে, কেন তাকে সে দায়িত্ব দেয়া হলো এর সঠিক ইতিহাস ৪৭ বছর পর কি সঠিক আছে? প্রশ্নটা আওয়ামী ও বিএনপি গঠিত ও সমর্থিত সকলের প্রতি রইল। কেননা, আওয়ামী লীগ বলে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন, বিএনপি বলে জিয়াউর রহমান স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছেন। আবার বলেন, আওয়ামী লীগ দেশের সাথে মিরজাফরী করেছে, প্রশ্ন হলো তখন কি আওয়ামী বিএনপি ছিল? নাকি পূর্বপাকিস্তান একটি দলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল? নেতৃত্ব কিংবা ঘোষণা দিয়ে যদি দেশ স্বাধীন করা যায়, তবে কেন এই নেতৃত্ব কিংবা ঘোষণা দিয়ে সকল বিদ্বেষ মুছে ফেলা যায় না? কেন আজ দেশের স্বাধীনতার এই কলঙ্ক? এই প্রজন্মের জনগণ কেন জানে না কোনটা সঠিক তথ্য? আজকের বিজয় দিবসেও এক দল আরেক দলের গীবত করবে নির্লজ্জের মত নোংরা ভাষায়। গীবতের প্রতিযোগিতা হয় পৃথিবীর অন্য কোন দেশে নয় আমাদের দেশে। যে দেশের স্বাধীনতার জন্য এদেশের অনেক সন্তান প্রাণ দিয়ে বিজয় এনেছেন, অঙ্গ হারিয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করে অনাহারে-অর্ধাহারে পথে-ঘাটে জীবন-যাপন করছেন, আবার অনেক পিতা-মাতা সন্তানকে, স্ত্রী স্বামীকে, সন্তান বাবা-মাকে স্বাধীনতার যুদ্ধে সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করছেন। তাঁদের কাছে আজ এ বিজয়ের তাৎপর্য কী? স্বজন হারাগণ সত্যি কি আজ বিজয়ের স্বাদ উপভোগ করছেন? যারা স্বাধীনতার বিজয়টাকে বিকলাঙ্গ করে ধ্বংস করে ১৮ টুকরো করে ভাগা দিয়ে ফ্রিজে সংরক্ষণ করে থাকে তাদেরই তো বিজয়! সত্যিই আজ তাদেরই বিজয় দিবস। আজ সূর্য উদিত হোক- সেই বিজয় নিয়ে যে বিজয়ের জন্য শহীদেরা জীবন দিয়ে গেছেন।উঁচু তলার উচ্চ মহলে অন্ধকারের মৃদু আলোয় বসে তৈরী করে প্রথম সারির গুণগত মানসম্পন্ন দক্ষ হাতিয়ার, নাককরণ করা হয় শীর্ষ সন্ত্রাস। এই শীর্ষ সন্ত্রাস মারা যায় ক্রসফায়ারে কিংবা বিভিন্ন কৌশলে। ধরা ছোঁয়ার অনেক ঊর্ধ্বে থেকে ধাপে ধাপে সন্ত্রাস তৈরী করেই যায় তারা। বিজয় তো তাদের, কেবলই তাদের! সত্যিই আজ তাদেরই বিজয় দিবস! এবারের বিজয়ের সূর্য উদিত হোক- সেই বিজয় নিয়ে যে বিজয়ের জন্য শহীদেরা জীবন দিয়ে দিয়ে গেছেন স্বাধীনতা।
১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর তারিখে বাংলাদেশের বিজয়ের মাধ্যমে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধের অবসান ঘটেছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয়ের এই দিনে জাতি এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে, শুরু হয় নবযাত্রা। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্র বাংলাদেশের সগৌরব আবির্ভাবকে স্বীকৃতি প্রদান করে, আমাদের দেশ মর্যাদার আসন লাভ করে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে। তাই বিজয় দিবস জাতির মর্যাদা ও গৌরবের দিন, জাতির গর্বের দিন, জাতীয় জীবনে একটি অনন্য দিন। আজ এই বিজয়ের দিনে কথাগুলো কেবলমাত্র এই বাংলাদেশের পরিসীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ। বাংলাদেশ এখন আর বিশ্বের দরবারে মর্যাদার কিংবা সম্মানের নয় বরং কলঙ্কের। দূর্নীতিতে বাংলাদেশ আজ চতুর্থবারের মত চ্যাম্পিয়ন দেশ। এই জন্যই-কি দেশ স্বাধীন করা হলো? যাঁরা মাতৃভূমির জন্য এক অনন্য দৃষ্টান্তের ইতিহাস সৃষ্টি করে গেল সেই ইতিহাসেরই অপর পৃষ্ঠায় দূর্নীতিতে চ্যাম্পিয়নের দৃষ্টান্ত খচিত করল এদেশেরই সন্তান। কি আশ্চর্য তাই না! দুঃখ! আবার তারাই বড় বড় বুলি আওড়ায় দেশপ্রেমিক হিসেবে, স্বাধীনতার সংগ্রামের যোদ্ধা হিসেবে।
এদের মধ্যে অনেকেই উচ্চ মহলে, প্রশাসনে কর্মরত, আবার অনেকে দেশবরেণ্য নেতা। ভাবতে অবাক লাগে তাদেরই সহযোদ্ধারা কেউ ভিক্ষা করে জীবন পার করছে, কেউ চা বিক্রি করে অনাহারে-অধাহারে দিন কাটাচ্ছে। কিন্তু এদের জন্য নামী-দামী যোদ্ধাদের হৃদয় কোন অনুভূতি স্পর্শ করছে না। কি চমৎকার! জীবনবাজী রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করে একমুঠো ভাতের জন্য পথের ধারে হাত পেতে বসে থাকে অন্যদিকে হানাদার বাহিনীদের সহযোগিতা করে, কিংবা যুদ্ধের সময় দেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে বিত্তবানে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার বিজয় এভাবেই ভাগ হয়েছে। হতভাগা মুক্তিযোদ্ধারা ফুলের মালার পরিবর্তে হাতে পেয়েছে ভাঙ্গা থালা। আজ সূর্য উদিত হোক- সেই বিজয় নিয়ে যে বিজয়ের জন্য এদেশের সন্তানেরা জীবনবাজী রেখে দেশের জন্য যুদ্ধ করে গেছে।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর পরই বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের যে শাসন ও শোষণ নীতির শিকার হয়েছিল, রক্তাক্ত সংগ্রামের মাধ্যমে এর অবসান ঘটে ১৬ই ডিসেম্বরে। দীর্ঘদিনের স্বাধিকার আদায়ের সংগ্রামে জুলুম-হত্যার যে বিভীষিকার সমাপ্ত ঘটে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বরে বিজয় দিবসে। আজ ৪৮তম বিজয় দিবস কিন্তু দেশে কি আজ বিভীষিকার সমাপ্তি ঘটেছে? জাতি কি আজ শাসন-শোষণ-অত্যাচার মুক্ত? ১৯৭১ সালে এদেশের অনেক নারী নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, ধর্ষিত হয়েছে খানসেনাদের হানাদার বাহিনীদের দ্বারা। তাদের উরসজাত সন্তান গর্ভে ধারণ করে দুর্বিষহ জীবন কাটিয়েছেন, কাটাচ্ছেন অনেক নারী। আজ বাংলাদেশের বয়স ৪৮বছর। স্বাধীন বাংলাদেশের নারীরা কি এ থেকে রেহায় পেয়েছে? না পায়নি। ধর্ষিত হচ্ছে পিতার সামনে কন্যা, ভাইয়ের সামনে বোন, সন্তানের সামনে মা, স্বামীর সামনে স্ত্রী। বিভিন্ন ছল-চাতুরি করে গর্ভে সন্তান জন্ম দিয়ে আনন্দ-উল্লাস করে আর গর্ভধারিণী সমাজের কাছে, আইনের কাছে ধারস্থ হয় ন্যায় বিচারের আশায়, ক্লান্ত হয়ে খুশীমত জীবন বেছে নিয়ে আত্মহত্যাই করে বেশী, এতো গেল নারী সমাজ, এবার আসি সমগ্র জাতিতে।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানী বাহিনী দেশজুড়ে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালায়, জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দেয় বাড়িঘর। আজ কি এর ব্যতিক্রম? আজ আমরা স্বাধীন জাতি, আমাদের দেশে তো এখন আর পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী নেই, নেই রাজাকার আলবদর, তবু কেন এসব হচ্ছে? এসব করছে কারা? এখন কেন অন্যায়-অত্যাচারে, শাসন-শোষণে নেতাজীরা অতিষ্ঠ হচ্ছে না? কেন আইন নিজের গতিতে চলছে না? কেন সাধারণ মানুষ আজ সর্বক্ষেত্রে সর্বভাবে শঙ্কিত? কেন শান্তি-শৃঙ্খলার পরিবর্তে অশান্তি-বিশৃঙ্খল অবস্থা বিরাজ করছে স্বাধীন দেশে? জাতি আজ জাতির কাছেই পরাজিত, স্বাধীন হয়নি আমাদের দেশ। মাতৃভূমি যে তারই খানসেনা, রাজাকার আলবদর সন্তদের হাতে বন্দী। মাতৃভূমি তোমার সন্তানরা এখন আর মুক্তিযোদ্ধা নয় এখন তারা রাজাকার, আলবদর, খানসেনায় পরিণত হয়েছে। তাই স্বাধীনর বিজয় সেই দিনই হবে যেদিন জন্মভূমি মাতৃভূমি মা-গো তুমি, তোমার দেশদ্রোহী সন্তানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, সুসন্তানের হাতে দেশ তুলে দিবে, বিজয়ের আনন্দ সমভাবে সমগ্র-জাতিতে ছড়িয়ে দিবে।
এবারের ১৬ই ডিসেম্বর সূর্য ঐ বিজয় নিয়ে উদিত হোক যে বিজয়ের জন্য এদেশের সন্তানরা প্রাণ দিয়েছিল, নারীরা দিয়েছিল তাদের সম্ভ্রম।
আজ আমাদের দেশের ৪৮তম বিজয় দিবস। আমার এ লেখাটা ৩৪তম বিজয় দিবসের। এত বছরেও সামান্যতম পরিবর্তন ঘটেনি বিজয়ের তাৎপর্য।
No comments:
Post a Comment